শুদ্ধাচারের নীতি হোক শিশুর জীবনের ভিত্তি

শুদ্ধাচারের নীতি হোক শিশুর জীবনের ভিত্তি

সচেতনতা। জিনাত আরা আহমেদ

শুদ্ধাচারের নীতি হোক শিশুর জীবনের ভিত্তি

আমরা মধ্যম আয়ের দেশ গড়তে যাচ্ছি, উন্নত দেশের স্বপ্ন এঁকেছি, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছি। উন্নয়নের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সারাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। সরকারের এ অগ্রযাত্রায় যাতে কোনোভাবেই দুর্নীতির কালো মেঘ ছায়া ফেতলে না পারে সেজন্য আজ গ্রহণ করা হয়েছে দুর্নীতি বিরোধী শুদ্ধি অভিযান, যা সবার প্রশংসা অর্জন করেছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি এবং সরকারি অফিসগুলোতে নীতি নৈতিকতার চর্চা তথা শুদ্ধাচারের নীতি প্রতিপালনের জন্য কৌশল প্রণীত হয়েছে। অবশ্যপালনীয় নীতি হিসেবে এটা বাস্তবায়নে নানা কর্মসূিচও চলমান। সততা ও শৃংঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশে দক্ষ জনশক্তি এবং নতুন চিন্তা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়া সরকারের লক্ষ্য। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে নীতিহীন ব্যক্তিরা অনিয়মের বাহক হিসেবে মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে চলেছে। তাদের যেমন আইনের মাধ্যমে রুখে দিতে সরকার বদ্ধপরিকর, তেমনি সময় এসেছে শুদ্ধচিন্তার ধারক নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে উন্নত দেশ গড়তে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার। এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের সাথে সাথে দরকার পারিবারিক মূল্যবোধ আর অনুশাসনের আবহে শৃংঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ।

শিশু প্রথমত পারিবারিক পরিবেশেই শৃঙ্খলা শেখে। বাবা-মায়ের পারস্পরিক বোঝাপড়া, অন্যদের সাথে আচার-ব্যবহার, বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময়-এসব কিছু শিশুর মানস গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিনের নির্দিষ্ট সময় কাটানোর ফলে সেখানের পরিবেশও শিশুর জীবনের ভিত্তি গড়ে দেয়। তাই শুদ্ধচিন্তার অধিকারী হতে পরিবার ও বিদ্যালয়কে হতে হবে শিশুদের মূল্যবোধ বিকাশের ক্ষেত্র, যাতে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত প্রতিটি শিশু বাবা-মা আর শিক্ষকের নৈতিক আদর্শে গড়ে উঠতে পারে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাতীয় নীতিগুলোকে শৈশব থেকে আত্মস্থ করতে পারে।

অনেকের মধ্যে অর্থই জীবনের পরমার্থ এমন ধারণা কাজ করে। অন্যের কাছে নিজের বিত্ত-বৈভব প্রদর্শনের আকাঙ্খা তাদের আরও বেশি উপার্জনে তাড়িত করে। এসব লোকেরা যেনতেন উপায়ে অর্থ উপার্জনের জন্য অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। দুর্নীতির কারণে এরা বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়, যার প্রভাব সন্তানদের জীবনেও পড়ে। অবৈধ উৎসের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ সন্তানদের বেহিসেবী করে তোলে। তখন অধিক ব্যয়ের প্রবণতা ওদের শৃংঙ্খালাহীন জীবনের দিকে ধাবিত করে। এটা কারো জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে না। বাহ্যিক চাকচিক্যের প্রতিযোগিতায় জীবন একপর্যায়ে অর্থহীন মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে জীবনের সুকুমার বৃত্তিগুলো চর্চার মাধ্যমেই মানুষ অনাবিল সুখের সন্ধান পায়। তাই শৈশব থেকেই শিশুকে শেখাতে হবে জীবনে সুখী হবার মন্ত্র।

শিশু যে পরিবেশে বড় হয় সেখানকার সার্বিক বিষয় পরবর্তী জীবনে তার আচরণে প্রকাশ পায়। পরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষা পেলে সে অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। সমালোচনা করলে শিশু হীনমন্যতায় ভোগে। এধরনের পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুরা কাউকে শ্রদ্ধা করতে শেখে না। বাড়িতে কাজের লোকেদের সাথে শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার তাকে সমাজের ছোট-বড় সকলের সাথে সমান ব্যবহারে অভ্যস্ত করে তোলে।

কোনো জিনিসের প্রতি লোভের মাধ্যমেই দুর্নীতির সূত্রপাত। তাই শৈশব থেকে নির্লোভ চরিত্রের অধিকারী হতে শিশুকে সংযম শিক্ষা দিতে হবে। শিশুদের হাতে কখনই নগদ অর্থ দিতে নেই। কাউকে কিছু দিতে পেরে আনন্দিত হওয়াকে শিশু যেন উপভোগ করতে পারে তার চর্চা থাকতে হবে। মোবাইল ফোনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু কখন সেটা প্রয়োজন, এর জন্য বয়সের বিষয়টা বিবেচনায় নেয়া দরকার। অনেক অভিভাবক শিশুকে মোবাইল ফোন ধরতে দেন, এ থেকে এক ধরনের আসক্তি তৈরি হতে দেখা যায়। আবার কোন কোন সচ্ছল অভিভাবক স্কুল পর্যায়ের শিশুকে মোবাইল কিনে দেন, তার দেখাদেখি সাধারণ পরিবারের শিশু যখন বায়না ধরে তখন বাবা-মা বিব্রত হন। এরকম পরিস্থিতিতে পরিবার এবং বিদ্যালয়ে নানা ধরনের সংকট তৈরি হয়। তাই নৈতিকতার সার্বিক বিষয়ে শিশুর বাবা-মায়েরও ধারণা থাকতে হবে।

সমাজ পরিবর্তনে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি থাকতে হবে সামাজিক উদ্যোগ। বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ, অন্যদের সহযোগিতা করার মনোভাব, আয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্যয়ের প্রবণতা, নীতি নৈতিকতার বিভিন্ন বিষয়ে অভ্যস্ত করে তুলতে শৈশবেই প্রশিক্ষণ জরুরি।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিদ্যালয় হলো শিশুর প্রথম প্রশিক্ষণকেন্দ্র। শিক্ষক প্রতিনিয়ত চর্চার মাধ্যমে শিশুকে নৈতিক গুণাবলি আত্মস্থ করতে সাহায্য করবেন। এভাবে শিশু কতটা অর্জন করলো, তার নিয়মিত দিনপঞ্জিতে সেটা প্রতিফলিত হয় বিদ্যালয়ে তা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিৎ। এতে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে সঠিক পরিশুদ্ধি অর্জিত হয়। সঠিক দিক দিয়ে রাস্তা চলা, দেখেশুনে রাস্তা পার হওয়া, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলা, সবক্ষেত্রে আইন মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রভৃতি বিষয়ে স্কুলগুলোতে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন।

শিশুকে নিয়ম শেখানোর পাশাপাশি নিজেরাও নিয়ম মেনে চললে অনেক বেশি কার্যকর হয়। আমরা যদি সময় অসময়ে টিভি দেখি বা কাজের সময় ফোনে আড্ডা দেই, তাহলে ছেলেমেয়েরাও নিয়ম মেনে দায়িত্ব পালনে অভ্যস্ত হবে না। অনৈতিক বিষয়ে সন্তানদের সমর্থন করা কখনই ঠিক না। বাচ্চারা কোন অন্যায় করলে বুঝাতে হবে ভুলটা ভুলই, এক্ষেত্রে বাবা-মা উভয়েই সমমত পোষণ করবেন। সন্তানকে শাসনের ক্ষেত্রে অসঙ্গতিপূর্ণ শব্দ প্রয়োগ কিংবা কারো সাথে তুলনা করা ঠিক হবে না, এতে শিশুর আত্মবিশ্বাস কমে যায়।

সন্তানদের কথা শোনা এবং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিলে ওরা বুঝতে পারবে যে, পরিবারে সেও একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ওর পছন্দ-অপছন্দের গুরুত্ব দেয়া এবং কথাবার্তায়, আচার-আচরণে ইতিবাচক ইঙ্গিত থাকলে শিশু উৎসাহিত বোধ করে। শিশু কী ভালোবাসে, কিসে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, কখন পড়তে চায়-এসব বিষয় মাথায় রেখে রুটিন তৈরি করা যেতে পারে। তবে একবার রুটিন তৈরি হয়ে গেলে তা যেন নড়চড় না হয়। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, সন্তানকে সময় দেয়া প্রয়োজন। এতে করে শিশু বাবা-মাকে ভালো করে চিনতে পারে। খাওয়ার টেবিলে আলোচনার ফাঁকে কিংবা অবকাশ ও বিনোদনের সময়গুলোতে সুস্থ ও রুচিশীল সামাজিকতার খুঁটিনাটি ওর মধ্যে গেঁথে দেওয়া যায়। এভাবে সন্তানের কাছে নিজেদের আদর্শের বিষয়, এমনকি নিজেদের ‘রোল মডেল’ হিসেবে তুলে ধরা যায়।

শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। শিশুদেরকে আমরা যেভাবে গড়ে তুলবো, সেভাবেই তারা গড়ে উঠে, দেশকে নেতৃত্ব দেবে। আগামীতে যাদের হাতে আমরা দেশ ও সমাজের নেতৃত্ব তুলে দিতে চাই, তাদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজকের শিশুরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।

লেখক : কলামিস্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *