তানজিল আমির : শোলাকিয়া ময়দানে লাখো মুসল্লির সমবেত ঈদ জামাত এখন বাংলাদেশের চিরায়ত ঐতিহ্য। ঐতিহাসিক এ ঈদগাহে নামাজ আদায়ের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসল্লি জড়ো হন। কবি নজরুলের ভাষায়- ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ। আলিশান ঈদগাহে লাখো মানুষের একসঙ্গে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে ইসলামের সার্বজনীনতা ফুটে ওঠে। নিজের মনোবল ও ঈমানি চেতনা বৃদ্বি পায়। তাই তো শোলাকিয়ায় প্রতিবছর লাখো মানুষের ঢল নামে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন মুসল্লি এ জামাতে শরিক হতে, ইতিহাসের সাক্ষী হতে। এ ঈদে আমিও ছুটে গিয়ে ছিলাম গ্র্যান্ড ইমাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের সফরসঙ্গী হিসেবে। মাকনুন ভাইকে নিয়ে আমরা চাঁদ রাতেই রওনা হয়ে কিশোরগঞ্জ সার্কিট হাউসে রাত যাপন করি। ফজরের আগ থেকে পায়ে হাঁটা মানুষের সে াত শুরু হয়ে যায়। সার্কিট হাউস থেকে আমরা প্রাণভরে মনোরম সে দৃশ্য উপভোগ করি। ফজরের পর বৃষ্টির কিছু আভাস থাকলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রোদ উঠে যায়। যদিও বৃষ্টির সঙ্গে শোলাকিয়ার মুসল্লিদের সখ্য বহু পুরনো। এ ময়দানে অধিকাংশ নামাজই হয়েছে বৃষ্টিঝরা অবস্থায়। সকাল ৯টার কিছু পরে গ্র্যান্ড ইমামের সঙ্গে আমরা ময়দানের উদ্দেশে বের হই। মানুষের স্রোত তখন উপচে পড়েছে মাঠে। নিরাপত্তা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল বেশ। ময়দানের সানী ইমাম মুসল্লিদের দিকনির্দেশনামূলক বয়ান রাখছিলেন। সকাল ১০টার কিছু আগে ঐতিহ্য রক্ষায় ফাঁকা গুলি ছুড়ে সতর্ক করা হল। আমরা ছিলাম ময়দানের একদম শুরুতে মিহরাবের কাছে। ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক দশটা, তখন ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবির দিয়ে গ্র্যান্ড ইমাম নামাজের নিয়ত বাঁধলেন। পুরো ময়দান নীরব, নিথর, মাঠ ছাড়িয়ে পাশের রাস্তাঘাট ও বেইলি ব্রিজের ওপরও মানুষ দাঁড়িয়ে গেল। প্রায় দুই লাখ মানুষ একসঙ্গে কাতার সোজা করে দাঁড়িয়েছে মহান রবের সামনে। নত শিরে তারা শুকরিয়া জ্ঞাপন করছে প্রভুর। সফরের কারণে নামাজ শেষে কোলাকুলির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। সালাম ফেরাতেই শ্রদ্ধেয় মাসউদুল কাদির ভাই বুকে জড়িয়ে কোলাকুলি করলেন। স্বজনদের ছেড়ে প্রথম ঈদে খানিকটা নিঃসঙ্গ মনে হলেও এ সময় আনন্দ হাওয়া বয়ে গেল মনে। মাঠের সকলকেই মনে হলো আমার খুব আপনজন। ঈদের আনন্দে আমরা পরিচিত-অপরিচিত অনেকের সঙ্গে কোলাকুলি করি। খুতবা ও মোনাজাতে দেশ ও মুসলিম উম্মাহর শান্তি সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা হয়। এ সময় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের চোখও অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা হয় এ সময়। দায়িত্বের চাপে কয়েকদিন খাবার ও ঘুম তাদের ঠিকমতো হয়নি। এমনকি ঈদের দিন সকালে সামান্য সেমাইও খাননি তারা। এভাবে তাদের ত্যাগ ও কষ্টে লাখো মুসল্লি শান্তিপূর্ণভাবে নামাজ আদায় করেন। মোনাজাতে লাখো মানুষের আমিন আমিন ধ্বনীতে পুরো এলাকা আবেগময় হয়। দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষগুলোর চোখের পানি ঝরতে থাকে অঝোরে। এ ময়দানের সঙ্গে লাখো মানুষের আবেগ ও ভালোবাসা জড়িত। আগামীতে আবার আসার প্রত্যয়ে বিশেষ ট্রেন ও বাসে করে দূরের মানুষজনও বিদায় নিলেন। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিলনমেলার বেদনাবিধুর এ ভাঙন দৃশ্য দেখলাম। ঈদ আসে বিশ্ব সমাজে মানবিকতা জাগিয়ে সাম্যের জয়গান তুলতে। নজরুলের ভাষায় বলি- আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে, তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ। ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
শোলাকিয়া থেকে ফিরে
tanjil.amir@yahoo.com
![শোলাকিয়ার সবাই যেন আপনজন](https://patheo24.com/wp-content/uploads/2017/07/solakia.jpg)