- আমিনুল ইসলাম কাসেমী
অত্যাধুনিক বিলাসবহুল বাস। একদম নতুন। বাসভর্তি যাত্রী। ড্রাইভার গন্তব্যে পৌঁছার জন্য ছুটে চলেছে। রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স ৮–৯ হবে। হাতে কিছু ম্যাগাজিন। সেগুলো দর্শনার্থীদের মাঝে বিক্রি করে, সে একজন ফেরিওয়ালী। হঠাৎ হাত দিয়ে সে ড্রাইভারকে ইশারা করল। তার হাতের ইশারায় বোঝা গেল সে পিপাসার্ত। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার গাড়ি থামাল। ড্রাইভারের কাছে সংরক্ষিত এক বোতল পানি তাকে পান করার জন্য দিল।
ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখলাম। অভিভূত হলাম, আহ! এঁরা কত ভাল মানুষ। আর চিন্তা করলাম নিজ দেশের কথা। আমাদের দেশে এরকম হাজারো ফেরিওয়ালা – ফেরিওয়ালী আছে। হাজারো শিশু রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে পসরা বিক্রি করছে। কিন্তু তাদের সাথে আমরা কত জঘন্য আচরণ করি। অনেক তাচ্ছিল্যের সাথে তাদের দেখি। বিশেষ করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালে শত শত শিশু দেখা যায়। যারা দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। অন্ন নেই, বাসস্থান নেই। কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। অসহায়ত্বের মাঝে তাদের জীবন কাটে। পেটের দায়ে যখন তারা রাস্তায় নেমে আসে, আমরা তখন তাদের সাথে রুঢ় আচারণ করে থাকি।
ভাল ব্যবহারে টাকা খরচ হয়না। কিন্তু সেই ভাল আচারণ আমাদের থেকে পায় না। বরং বহু লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হয় তারা।
অথচ একই মানুষ আমরা। কিন্তু পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সোনার এই দেশে সোনার মানুষই জন্ম নিয়েছে। এখানে প্রতিটি মানুষ খাঁটি। এমনকি যারা ভিন্ন দেশ থেকে এখানে এসেছে, তারাও এই ভাল মানুষের সংস্পর্শে ভাল হয়ে গেছে। এ যেন “সোহবতে সালেহ তরা সালেহ কুনাদ”, ভাল মানুষের সংস্পর্শে মানুষ ভাল হয়।
বেশ কয়েকবছর আগের কথা। সেদিন ছিল ৮ জিলহজ। হাজি সাহেবগণ মক্কা থেকে মিনায় যাচ্ছে। আমরাও রওনা হলাম। কিন্তু আমাদের জামাতের সব সাথি এক বাসে সংকুলান হলো না। জামাতটি তখন বড় ছিল। বাস কর্তৃপক্ষ গাড়ির মুর্শিদ (পথ প্রদর্শক)-কে বলল, ওনারা দুই ট্রিপে সাথিদের নেওয়ার চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে তোমার নাস্তা খরচ তারা বহন করবে। আমি মুর্শিদকে নাস্তা খরচ দেওয়ার জন্য রাজি হলাম। তখন সে গাড়ি নিয়ে আমাদের সাথিদের দ্বিতীয় ট্রিপে মিনায় পৌছে দিল।
মিনায় পৌঁছানোর পর সেই মুর্শিদকে আমি ৫০ রিয়াল হাদিয়া দিলাম। কিন্তু মুর্শিদ ৫০ রিয়াল নিতে অস্বীকৃতি জানাল। সে বলল, আমার নাস্তা করতে সর্বোচ্চ ১০ রিয়াল খরচ হবে। আমাকে ৫০ রিয়াল দিচ্ছেন কেন?
আমি বললাম, খুশি হয়ে তোমাকে দিচ্ছি। সে বলল, ‘১০ রিয়ালের বেশী আমার প্রয়োজন নেই।’ আমি কোনভাবেই তাকে ৫০ রিয়াল দিতে পারলাম না।
অবাক হলাম। সে ঘটনাটি এখনো আমার অন্তরে রেখাপাত করে আছে। কী সোনার মানুষ তারা! সত্যি তাদের সাথে কারো তুলনা হয় না।
এবার চিন্তা করি আমাদের অবস্থা। আমাদের আখলকের কত অধঃপতন হয়েছে। কর্মস্থল এবং দায়িত্বের ব্যাপারে আমরা কত গাফেল। বিশেষ করে আমরা যে যেখানে দায়িত্বরত, সেখানে কত অনিয়ম করে থাকি। কত টাকার তছরুফ হয়। কখনো প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচের ভাউচার করে বসি। ১০ টাকা খরচ হলে ২০ টাকা লিখি। কখনো অল্প হাদিয়ায় আমাদের হয় না, মোটা অংকের হাদিয়া লাগে। এক ঘন্টার কাজ, তার জন্য কত টাকার বায়না। এমনকি দ্বীনের কাজও মোটা অংকের পারিশ্রমিক ছাড়া করতে চাই না।
কিন্তু যাদের ঘটনাগুলো দেখালাম, অতি সাধারণ মানুষ তারা। তেমন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি নন। একজন গাড়ির ড্রাইভার, আরেকজন গাড়ির মুর্শিদ। কিন্তু সাধারণ এই মানুষের গুনাবলী যেন নবীওয়ালা। তাদের এমন আখলাক থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছু আছে। হতে পারে তারা সাধারন মানুষ। কিন্তু যে আখলাক তাদের মাঝে বিদ্যমান, সেটা অনেক উর্ধ্বের।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে নবীওয়ালা আখলাক গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
- লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট