সোশ্যাল মিডিয়া; ক্ষয়ে তারুণ্যের ভিত

সোশ্যাল মিডিয়া; ক্ষয়ে তারুণ্যের ভিত

ইয়াছিন নিজামী ইয়ামিন :: বাংলাদেশসহ গোটা দুনিয়া এখন মরণব্যাধি করোনাভাইরাস থেকে বাচঁতে প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। এরমধ্যে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা একলাখ ছাড়িয়েছে। এই মহামারী বর্তমানে সংক্রমণের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। প্রতিদিনই প্রায় তিন হাজার বা তারচেয়ে বেশি মানুষ এই রোগে সংক্রমিত হচ্ছে। এই ভয়াবহ অবস্থায় ‘লকডাউন’ নামে যে শব্দের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কঠিন দুর্বিপাকে পড়েছে নিন্ম ও মধ্যবিত্তের মানুষেরা। উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের দুর্বিপাকে না পড়তে হলেও বসে থাকতে থাকতে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে তাদের জীবন। আর এই অলস সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া ভালো ভাবেই ঘাড়ে চেপেছে তরুণদের। এদেশের অনেক শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিগণ এই মাধ্যমটাকে ব্যবহার করে পুরোদমে শিক্ষা-কার্যক্রমও শুরু করতে পারছেন না প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এর নিরেট সুবিধা পাচ্ছে না বা পাবে না বলে।

আজ বিশ্ববিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় এদেশ কত পিছিয়ে রয়েছে তাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এই করোনাভাইরাস! কিন্তু তারপরও প্রত্যেকেই তার পূর্বপ্রজন্মের অতিবাহিত সময় থেকে স্বীয় সময়টাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নত ধারনা করে থাকেন৷ সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়ে যদি আমরা দাবি করি, এসময়টা বিজ্ঞানের সর্বোৎকৃষ্ট সময়, তাহলে বোধ হয় খুব বেশি অতিশয়তার আশ্র‍য় নেয়া হয়েছে বলে কেউ মনে করবে না৷

বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উদ্ভাবন ও বর্ণাঢ্য আবিষ্কার আমাদের যাপিত জীবনের কিছু অংশকে সহজ-সরল করেছে ঠিকই, তবে প্রকৃত সত্য হলো, বিজ্ঞান যতটুকু না সহজ করেছে, তার চেয়ে বেশি কঠিন করে তুলেছে আমাদের জীবনাচারকে। পরনির্ভরশীলতা, আত্মহনন, আস্থাহীনতা, আতঙ্কসহ নব উদ্ভাবিত হরেকরকম অপরাধ ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে। অদম্য তারুণ্যের বিশাল পৃথিবীটাকে এতটুকু সোশাল মিডিয়ায় আবদ্ধ করে দিয়েছে। একদল এটাকে পুঁজি করে তরুণদের মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরনে উগ্রতা, লোভ, অহমিকা, অবাধ্যতা, ও বিশৃঙ্খলা ঢুকিয়ে দিচ্ছে অবচেতন মনেই। ক্রমান্বয়ে এইরোগ তরুণদের ছাড়িয়ে সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি থেকে নিন্মপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গদেরও এর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে।

আজকের যে তরুণের বিশাল বিস্তৃত আকাশ দেখে- ‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিল, উদার হতে ভাই রে”- শিক্ষায় দীক্ষিত হওয়ার কথা ছিল সে আজকে ফেইসবুকে পরনিন্দা সহিংস অশালীন স্থিরচিত্রে মাথা পূর্ণ করছে। যে তরুণের আজ বিশ্ব জয় করার কথা, সে আজকে ইউটিউবে ফলোয়ারের সন্ধানে গুমরে মরছে৷ এই লাগামহীন সোশ্যাল মিডিয়া তাদের আশা-প্রত্যাশা, লক্ষ্য-প্রতিজ্ঞা, শক্তি-সামর্থকে কেড়ে নিয়ে এক বিষাদময় জীবন দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে অন্তহীন মরুভূমির এক বর্ণিল মরিচিকার পেছনে৷ ভাবতে অবাক লাগে! এগুলো যাদের আবিষ্কার তারা এগুলো ছেড়ে জ্ঞানসাগরে অবগাহন করছে ঠিকই, আর আমরা এগুলোর পেছনে পড়ে স্বর্ণমূল্য প্রতিটি ক্ষণ ও জীবন নষ্ট করে চলেছি অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে। এমনকি তাঁদের এই আবিষ্কারের পাল্লায় পড়ে বিসর্জনও দিতে বসেছি ধর্মীয় মূল্যবোধকে। এর চেয়ে হতাশা আর দুঃখের কি হতে পারে!

এদেশে আমরা যারা নিজেদের মুসলিম বলে পরিচয় দেই, আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা বা জ্ঞান এত তলানিতে, যা কোনক্রমেই সন্তোষজনক বলা যায় না। তার উপরে যদি আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের সংকটে পড়তে হয়, তাহলে এ তো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-! এই সংকট পুরো সমাজকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার এই সোশ্যাল মিডিয়া দিন দিন এদেশের তরুণদের নিয়ে চলেছে নৈতিক অবক্ষয়ের চুড়ান্ত সীমায়। অথচ এই নৈতিক মূল্যবোধের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, অধ্যাবসায়, নিয়মানুবর্তিকা প্রভৃতি বিশেষ অনেক গুণ। এইগুণগুলোর চর্চার মাধ্যমেই মনুষ্যসমাজের নৈতিক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটে। এটিই মনুষ্য মানবিকতাবোধ জাগিয়ে তুলে মনুষ্যচরিত্রকে করে সুষমামণ্ডিত। তাই সুন্দর আত্মিক উন্নয়ন ও সুখ-সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে যুবসমাজ সহ সর্বস্তরের মানুষকে নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দানের বিকল্প নেই।

তাছাড়া একদল পামর স্বার্থান্বেষী মানুষ, সভ্যতা বিবর্জিত জামাত শিবির, উচ্ছৃঙ্খল বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত ও বন্ধুর পথে ঠেলে দিচ্ছে। এবং অযৌক্তিক ইহকাল ও পরকালীন প্রলোভন দেখিয়ে তাদের দ্বারা পরিচালিত করছে বিভিন্ন অনৈতিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। আমরা মনে করি, সুস্থ মেধায় ভাবলে এ দেশের বাঙালি তরুণদের এ কাজ করার কথা ছিল না। অর্থ আর অস্ত্রশক্তিতে বলীয়ান করে এবং প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা আড়াল করে শান্তির ধর্ম ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে তাদের ‘বাচলে গাজী মরলে শহীদ’-এর শিক্ষা দিয়ে জঙ্গি ও অমানবিক বানানো হয়েছে। যে তরুণদের সুন্দর ও ন্যায়ের পক্ষে থাকার কথা, দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত হওয়ার কথা, তারা নিগূঢ় তিমিরে নিপতিত হয়ে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদী অমানবিক ও অধর্মের পক্ষে কথা বলছে।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এটা, আমাদের দেশে সোশ্যাল মিডিয়া বা ইন্টারনেটের কোন সীমা-পরিসীমা বা অন্তরেখা নেই। নেই কোন সুষ্ঠু নিয়ম-পদ্ধতিও। এ যেন ভালো-মন্দ মিশেলের এক উম্মুক্ত প্রবেশ দ্বার। অথচ এদেশে আছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিরাট বিরাট আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়, আছে এবিষয়ের মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়, আছে সোশ্যাল ক্রাইমের ইন্টেলিজেন্ট গোয়েন্দা ফোর্স, এমনকি আছে এবিষয়ে আইন-কানুনও। এখানে নেই শুধু কোন নিয়ম-শৃঙ্খলা ও সঠিক নীতি-পদ্ধতির প্রয়োগ। এর-ই অভাবে দেশের মূল চালিকাশক্তি তরুণ সমাজ পরিচালিত হচ্ছে এক সংকটময় পথে যেপথ তাদের পৌঁছে দেবে উগ্রতা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, সহিংসতা, মাদকতা ও বেপরোয়া জীবনের অশুভংকর এক অধ্যায়ে। এটা এদেশের জন্য বড় এক অশনিসংকেত।

বিদ্বানজন মাত্রই বিশ্বাস করেন যুবসমাজ যেকোনো দেশের মূলশক্তি। এমনটা বারবার প্রমাণও করেছে তারা। তাই এদেশে সুন্দর একটি সমাজ বিনির্মানে, অতীত ইতিহাসের আলোকে বর্তমান ও ভবিষ্যতে, দেশ এবং জাতির উন্নতি সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় যুবসমাজকে সর্বোচ্চ গুরত্ব দিয়ে তদারকি, শিক্ষা-দীক্ষায়, সচেতনতা, প্রজ্ঞা ও মানবিকতার ছায়ায় সুনাগরিক হিসেবে তৈরি করা ব্যতিরেকে দোসরা কোন পথ নেই। না হয় অদূর ভবিষ্যতে এর পক্ষে এমন অশুমার মাশুল গুনতে হবে যা হবে সবার কল্পনাতিত। তাই এখানে দেশপ্রধান, প্রাজ্ঞ ও নিষ্ণাত ব্যক্তিদের সম্মিলিত ও সমন্বিত চিন্তা-ভাবনায়, দেশ ও দশের কল্যাণে এখুনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। এখনও এটা ভাবার সময় আছে- ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’।

লেখক: কওমি শিক্ষার্থী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *