হজ্জ ও ওমরা পরিচিতি ও হুকুম

হজ্জ ও ওমরা পরিচিতি ও হুকুম

শেখ শরিফ হাসানাত ● হজ্জ শব্দটি আরবি। আভিধানিক অর্থ হচ্ছে-ইরাদা, খেয়াল, আশা, নিয়ত এবং কোন মহৎ কাজের ইচ্ছা বা সংকল্প করা। শরীয়তের পরিভষায় হজ্জ বলা হয়, আল্লাহকে রাজী ও খুশি করার উদ্দেশ্যে শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থান তথা বায়তুল্লাহ শরীফ এবং সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহ নির্ধারিত আমল বা কাজের মাধ্যমে যিয়ারত করার সংকল্প করা। হজের নির্ধারিত স্থান হলো মক্কা শরিফে কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা, মুজদালিফা ইত্যাদি এবং মদিনা শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা শরিফ জিয়ারত করা। হজের বিশেষ আমল বা কর্মকাল হলো ইহরাম, তাওয়াফ, সাঈ, অকুফে আরাফাহ, অকুফে মুজদালিফা, অকুফে মিনা, দম, কোরবানি, হলক, কছর, জিয়ারতে মদিনা- রওজাতুল রাসুল ইত্যাদি।
পবিত্র হজ্জ আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ বিধান। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম হলো হজ্জ। জীবনে একবার হজ্জ করা ফরজ। এর ফরজ হওয়া পবিত্র কুরআর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সমর্থ পুরুষ ও নারীর ওপর হজ ফরজ। হজ্জ সম্পর্কে কোরআন শরিফে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ আছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার উপর ঐ ঘরের হজ্জ করা ফরজ এবং কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সে জেনে রাখুক নিশ্চয়ই আল্লাহ মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান; আয়াত: ৯৭)।
মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর হজ্জ ফরজ করেছেন। সুতরাং তোমরা অবশ্যই হজ্জ পালন করবে। (মুসলিম)
নবী করিম (সা.) বলেন, ‘হজ মানুষকে নিষ্পাপে পরিণত করে, যেভাবে লোহার ওপর থেকে মরিচা দূর করা হয়।’ (তিরমিজি)। যে ব্যক্তির ওপর হজ ফরজ করা হয়েছে অথচ তিনি হজ আদায় করেন না, তাঁর জন্য রয়েছে বিশেষ সাবধান বাণী। হজ মানুষকে নিষ্পাপ করে দেয়। রাসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি যথাযথভাবে হজ পালন করে, সে পূর্বেকার পাপ থেকে এ রকম নিষ্পাপ হয়ে যায়, যে রকম সে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন নিষ্পাপ ছিল।’ (বুখারি)।
জীবনে একবার হজ করা ফরজ। সামর্থ্যবানদের জন্য প্রতি পাঁচ বছর অন্তর হজ্জ করা সুন্নত। সুযোগ থাকলে বারবার বা প্রতিবছর হজ্জ করাতে বাধা নেই। যেকোনো অর্থ দ্বারা হজ সম্পাদন করা যাবে। হাদিয়া বা অনুদানের টাকা দিয়েও হজ্জ করলে তা আদায় হবে। চাকরি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল হিসেবে কর্তব্য কাজের সুবাদে হজ্জ করলেও হজ্জ আদায় হবে। এটি বদলি হজ্জ না হলে নিজের ফরজ হজ্জ আদায় হবে; ফরজ হজ্জ আগে আদায় করে থাকলে এটি নফল হবে। নফল হজ্জ অন্য কোনো ব্যক্তির বদলি হজ্জের নিয়তে আদায় করলে তাও হবে। (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরি)।

ওমরাহ
ওমরাহ শব্দটি আরবি । ওমরাহর আভিধানিক অর্থ হলো ধর্ম, কর্ম, ইবাদত, সুখকর, সেবা, স্থিতিশীল, জীবন, মহাপ্রাচীন, স্থাপত্য-স্থাপনা, প্রাপ্তি, অভ্যর্থনা, জিয়ারত বা সফর ও ইচ্ছা। যিনি ওমরাহ করেন, তাঁকে ‘মুতামির’ বলা হয়। (লিসানুল আরব)। শরীয়তের পরিভাষায় ওমরাহ হলো নির্ধারিত স্থানে নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদন করা। ওমরাহর নির্দিষ্ট কাজকর্ম হলো ইহরাম, তাওয়াফ, সাঈ, হলক, কছর ইত্যাদি। ওমরাহর নির্ধারিত স্থান হলো কাবা শরিফ, সাফা-মারওয়া ইত্যাদি। আফাকি তথা দূরবর্তী ওমরাহ সম্পাদনকারীর জন্য মদিনা মুনাওয়ারায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা শরিফ জিয়ারত করা সুন্নত। ওমরাহ সম্পাদনের বিশেষ কোনো সময় সুনির্দিষ্ট নেই; তবে হজ্জের নির্ধারিত বিশেষ সময়ে (৮ জিলহজ্জ থেকে ১২ জিলহজ্জ পর্যন্ত পাঁচ দিন) ওমরাহ পালন করা বিধেয় নয়; এই পাঁচ দিন ছাড়া বছরের যেকোনো দিন যেকোনো সময় ওমরাহ প্রতিপালন করা যায়। হজ্জের সফরেও ওমরাহ করা যায়। একই সফরে একাধিক ওমরাহ করতেও বাধা নেই। হজের আগেও (হজ্জ না করেও) ওমরাহ করা যায় এবং হজ্জের পরও বারবার ওমরাহ করা যায়। হজ্জ যেমন জীবনে একবার ফরজ, তেমনি ওমরাহ জীবনে অন্তত একবার সুন্নত।
রমজানে ওমরাহ পালন করা হজ্জের সমান সওয়াব; শাওয়াল মাসও ওমরাহ করার জন্য উত্তম সময়। তবে হজ্জ ফরজ থাকা অবস্থায় তা আদায়ের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও হজ্জ সম্পন্ন না করে বারবার ওমরাহ করা অযৌক্তিক। কারণ, শত-সহস্র ওমরাহও হজ্জের সমকক্ষ হবে না। অনুরূপভাবে ওমরাহ আদায় করলে হজ্জ ফরজ হয়ে যায়, এমনটিও সঠিক নয়।
ওমরাহর জন্যও হজ্জের মতোই মিকাত থেকে ইহরাম করতে হয়। বাংলাদেশ থেকে আমাদের মিকাত হলো ইয়ালামলাম পাহাড়, যা জেদ্দার পূর্বে অবস্থিত। মদিনা থেকে মিকাত হলো জুলহুলায়ফা নামক স্থান। মক্কা থেকে ওমরাহ করতে চাইলে তার মিকাত হলো তানয়িম বা আয়িশা মসজিদ অথবা জিরানা নামক জায়গা। (মক্কা থেকে হজ্জের ইহরামের জন্য মিকাত প্রযোজ্য নয়)। ওমরাহকে ‘ওমরাহ হজ্জ’ বা ছোট হজ্জও বলা হয়।
ওমরাহ সম্পর্কে কোরআন কারীমে রয়েছে: ‘নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনাবলির অন্যতম; তাই যারা হজ্জ করবে বা ওমরাহ করবে, তারা এতদুভয়ের প্রদক্ষিণ (সায়ী) করবে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৮)। ওমরাহ পালন করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আমল। এটি পুরুষ ও মহিলা সবার জন্য প্রযোজ্য। ওমরাহ করলে হজ্জ ফরজ হয়ে যায়, এ রকম কোনো বিধান নেই। মক্কা-মদিনার প্রতি আকর্ষণ ও হৃদয়ের টান ইমানের পরিচায়ক। তাই অনেকে প্রেমের টানে বারবার হজ্জ ও ওমরাহ করে থাকেন।
ওমরাহ নিজের জন্য যেমন করা যায়, তেমনি অন্যদের জন্যও করা যায়। জীবিত বা মৃত, ছোট বা বড়, আত্মীয় বা অনাত্মীয় যেকোনো ব্যক্তির জন্যও ওমরাহ আদায় করা যায়। যার জন্য ওমরাহ পালন করা হবে, তাকে আগে বা পরে জানানো বা অনুমতি নেওয়া শর্ত নয়; তবে তা জানানো উত্তম। ওমরাহ যেহেতু ফরজ বা ওয়াজিব নয়, তাই এর বদলি আদায় করা জরুরি নয়। তবে কাউকে যদি কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তি অসিয়ত করে যান, তা আদায় করা ওয়াজিব হবে। এ ছাড়া কেউ কারও দ্বারা ওমরাহ করালে উভয়ে সমান সওয়াব পাবেন; কেউ কারও জন্য ওমরাহ সম্পাদন করলেও উভয়েই পূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবেন। (ফাতাওয়া শামি)। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের কে হজ্জ পালন করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *