আত্মহত্যার আগে সবার কাছ থেকে বিদায় নাও | সাইমুম সাদী
মেয়েটি রিকশার গতিরোধ করে দাঁড়াল একেবারে সামনা সামনি। বলল, আংকেল একটা কথা বলব। কিছুটা ভয় পেলাম। অদুরে দাঁড়ানো পুলিশের সার্জেন্ট। তিনিও তাকিয়ে আছেন। পল্টনে নাস্তা করার কথা। দুইজন ওখানে অপেক্ষা করছেন। তাই রিকশায় উঠেছি।
ইতিমধ্যে শাহবাগ থানা লেখা একটা পুলিশের গাড়িও এসে দাঁড়াল রাস্তার ওপাশে। রিকশা থেকে নামার জন্য পা বাড়ালাম।
মেয়েটি বাধা দিয়ে বলল, নামার দরকার নেই। একটা কথা জিজ্ঞেস করার জন্য আপনাকে বিরক্ত করছি।
বললাম, বলতে পারো কি সেই কথা।
বলল, আমি আত্মহত্যা করতে চাই।
কোন নাটক নয়তো? মনে মনে চিন্তা করলাম। মেয়েটির বয়স হবে সতেরো আটারো এমন। চোখ দুটো ফোলা এবং লাল। অনেক কেঁদেছে মনে হয়। বুঝলাম ওটা কোন নাটক নয়।
বললাম, কখন আত্মহত্যা করতে চাচ্ছ?
আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটি খানিকটা চমকে উঠল। ওকে আরো বিভ্রান্ত করতে বললাম, সুইসাইড করার আগে সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়। তা কি নিয়েছ?
বলল, আপনি কেমন আংকেল বুঝলাম না। হুজুর মানুষ দেখেই কথা বলতে এলাম। আত্মহত্যা করলে কি আমি দোযখে চলে যাব?
বললাম, আগে বলো কেন আত্মহত্যা করতে চাচ্ছ?
সে অনেক কথা। ও চলে গেছে আমাকে ছেড়ে। আরেকজনের সাথে এখন লটরপটর করে। আমি ওকে ভুলতে পারছি না। ওকে ছাড়া আমি বাচতে পারব না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
মুখটাকে খুব বেজার করে বললাম, ভেরি স্যাড। লাভ স্টোরিগুলো সাধারণত এরকমই হয়। তবে একটি কথা কি জানো …
জ্বী, বলুন।
যে তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে তাকে নিয়ে চিন্তা করে মরে যাওয়ার কোন মানে নেই। যে তোমাকে ভালবাসবে তার জন্য মরলেই ত মজা। সে অন্তত আরেকটি রিলেশনে জড়ানোর আগ পর্যন্ত তোমার জন্য কিছুক্ষণ হলেও কাঁদবে।
যে ভালবাসবে সে আরেকটি রিলেশানে জড়াবে? অসম্ভব।
খুবই সম্ভব। তুমি সুইসাইড করলে সর্বোচ্চ এক মাস, এক বছর, পাচ বছর শোক পালন করবে, তারপর নতুন রিলাশানে জড়াবে, বিয়ে করে ঘর সংসার করবে, এটাই নিয়ম। লাইলি মজনুর কাহিনী শুধু সিনেমায় চলে বাস্তবে চলেনা। জীবন এরকমই।
কিছুটা বিভ্রান্ত হতে দেখা গেল তাকে। ভোরবেলার পথচারী কিছু মানুষ ইতিমধ্যে জড়ো হয়ে গেছেন আশেপাশে।
মেয়েটি বলল, তাহলে এখন আমি কি করব?
পলাশীর মোড় থেকে একটু দূরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের সবুজ মাঠ। আমি ওদিকে আংগুল দিয়ে ইশারা করে বললাম, আপাতত এই সবুজ শিশিরে ভেজা ঘাসের দিকে, দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের দিকে তাকাতে থাকো। দেখ পৃথিবটা কত সবুজ, কত বড়।
রিকশাওলাকে রিকশায় উঠার ইংগিত দিয়ে বললাম, আমার হাতে একটি ভালবাসার বই আছে। তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। তুমি ওটা পড়বে এক সপ্তাহ। পড়ার পর যদি মনে হয় সুইসাইড করা উচিত তাহলে তা তোমার ইচ্ছা।
এইবার দূরে দাঁড়ানো পুলিশ সার্জেন্ট এসে বললেন, বইটা দেখি। কিসের বই?
বইটা হাতে নিয়ে তিনি উল্টে পাল্টে দেখলেন। বইয়ের নাম মাআরিফে মসনভী। লেখক হাকীম আখতার রহ.। মসনভীর কিছু কবিতার ব্যাখা করেছেন তিনি এই বইয়ে চমৎকার ভাবে।
মেয়েটি পুলিশের হাত থেকে চট করে বইটা নিয়ে ফুটপাত ধরে হাটতে লাগল। সার্জেন্ট হেসে ফেললেন। আমি বললাম, নিশ্চিত আমি ওই মেয়ে সুইসাইড করবেনা।
সার্জেন্ট বললেন, আমাকেও একটা বই দিবেন প্লিজ।
বললাম, অবশ্যই।
আমার রিকশা চলতে লাগল। ভোরের শীতল হাওয়া ঠেলে সামনে যেতে ভাল লাগছে। মাআরিফে মসনভী বইটি কয়েকজনকে গিফট করব ভাবছি। চমৎকার লাভ স্টোরির একটি অনবদ্য গ্রন্থ।
লেখক : গবেষক