একটি শার্ট আর বাবা-ছেলের গল্প
জাকারিয়া জাকি : ছেলেবেলায় আব্বার দেয়া প্রথম শার্টটা কেনার জন্যে কম করে হলেও পঞ্চাশটা দোকান ঘুরতে হয়েছে। আব্বা দাম জিজ্ঞাসা করে করেই বারবার দোকান বদলাচ্ছিলেন। কোথাও পছন্দ করা শেষ, তবুও আব্বা দোকানদারকে বললেন- ঠিকাছে-রেখেদেন।
কোনভাবেই বুঝে আসছিল না আমার। আব্বা কেন বারবার এমন করছেন। অভিমান করে বললাম- ‘তোমার আসলে আমাকে শার্ট কেনে দেয়ার ইচ্ছেই নেই’। এমন কথায় আব্বা একদম চুপ হয়ে গেলেন।
তখনও বুঝতে শিখিনি, আব্বার আয় করা টাকা দিয়ে শুধু আমার নয়, পুরো সংসারটাই চালাতে হয়। দোকানদাররা বাবাকে নিয়ে কটাক্ষ করছিলো। ভ্রুকুটি করে ‘হাহাহা’ করে হাসছিল। আব্বা তাদের দিকে মনযোগ দিচ্ছিলেন না। শুধু একের পর এক দোকান বদলে যাচ্ছেন। মা’কে বলছিলেন- চলো, এখান থেকে আজকে আর কাপড় কেনা যাবে না। —’কেন কেনা যাবে না, সেটা বুঝার জন্য আমার অপেক্ষা করতে হয়েছে আট বছর।’
যেদিন প্রথম নিজের টাকা দিয়ে শার্ট কেনার জন্যে বাজারে গিয়েছিলাম। সেদিন বুঝিনি দোকান বদলানোর হেতুটা। ক্রমান্বয়ে রেগে যাচ্ছিলাম আরো। আব্বা শুধু দেখছিলেন। ব্যর্থতার ছাপ চোখে-মুখে নিয়ে পথ চলছিলেন। মাথা নিচু করে। যেন নিজেকে লুকিয়ে নিচ্ছেন।
অবশেষে শার্ট কেনা হল, কিন্তু আমার পছন্দ হয়নি। কালারে-ডিজাইনে কোন ভাবেই নয়। শুধুমাত্র মায়ের দিকে তাকিয়ে ফেলে দিতে পারিনি সেদিন। মনে অনেক কষ্ট-রাগ জমা রেখে মুখ বুজে শার্টের ব্যাগটা হাতে নিয়েছিলাম। ঈদে নতুন শার্টটা আর পড়া হয়নি। যাওয়া হয়নি ঈদগাহ্ তেও।শুধু একটাই অভিমান- আমার পছন্দের মূল্যায়ন কেন করলেন না আব্ব!
আমি সেদিন বুঝতে পারিনি। সব আব্বাদেরই স্বপ্ন থাকে, তার ছেলেকে পছন্দের পোশাক কেনে দেয়ার। স্বপ্ন থাকে ঈদের দিনে ছেলের মুখে হাসি ফুটানোর। কিন্তু আব্বা সেদিন আমার মুখে হাসি দেখতে পাননি। আমার অভিমানগুলো বাবা দেখতে পেয়েছিলেন। দেখতে পেয়েছিলেন সন্তানের চোখে নিজের ব্যর্থতা—অপারগতা।
উপায়হীন হয়ে শান্তনা দিতে চাইলেন।আমি সেই সুযোগ দেইনা। মুখ ফিরিয়ে নিলাম। এক সময় আব্বার সামনে কেটে টুুকরো-টুকরো করে ফেল্লাম তার কষ্টের টাকায় কেনা শার্টটা। আব্বা উঠে চলে গেলেন। শুধু গামছাটা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলে গেলেন- আমি পারিনি বাবা। পারিনি তোমার আশা পূরণ করতে। আমি দুঃখিত। আমাকে ক্ষমা করো বাবা।
তারপর থেকে আব্বার সাথে কোনদিন দেখা হয়নি আমার। কোনদিন গায়ে দেয়া হয়নি আব্বার কেনে দেয়া শার্ট। দেখা হয়নি চোখে-মুখে ব্যর্থতার ছাপ। দেখা হয়নি আমার আব্বার মুখ।
একটিবার। শুধু একটিবার যদি দেখা হতো! হঠাৎ কোন রাস্তার গলিতে! যদি গায়ে গা লেগে যেত কোন মোড়ে! তবে আব্বা বলে চিৎকার করতাম। শুধু ‘আব্বা আব্বা আব্বা ও আব্বা’ বলতে থাকতাম। আর বলে দিতাম- আব্বা! আমি দুঃখিত …