গুজবে রুখে দাঁড়ান | আবুদ্দারদা আব্দুল্লাহ

গুজবে রুখে দাঁড়ান | আবুদ্দারদা আব্দুল্লাহ

গুজবে রুখে দাঁড়ান | আবুদ্দারদা আব্দুল্লাহ

হ্যাঁ রুহান, তুমি নামাজ কালাম পইড়ো। আল্লাহ ছাড়া আসলে কেউ বাঁচাইতে পারবে না। আমি আজকে দুইটা করোনা রুগী রিফিউজ করছি, কথা বুঝতে পারছো? আমার এখানে তিনটা রুগী ভর্তি হইছে। গত এক সপ্তাহে দুইটা মারা গেছে। এখন এগুলো কাউকে বলতেও পারছি না। গভর্মেন্ট থেকে এগুলোর প্রেশার আছে, ঠিক আছে?

মেডিকেলে অনেক রুগী মারা গেছে। চিটাগংয়ে আমার জানামতে গত দুইদিন প্রায় আঠারো উনিশ জন মারা গেছে। এটা কিন্তু খুব বাজেভাবে মরবে। গভর্মেন্ট কেন ইনফরমেশন হাইট করতেছে আমি জানি না। তুমি সাবধান থাইকো আর কি। আসলে খুবই টেনশনে আছি। আল্লাহই মাফ করুক। আল্লাহ এখানে কোথা, কি রাখছে। আমার অবস্থা তো খুবই খারাপ। আমি তো এখানে চাকরি, চাকরি না করলে পেট চলবে না।

উপরের কথাগুলো ম্যাসেজ আকারে গত দুইদিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো সাড়া ফেলেছে। হাজার হাজার মানুষ ফরোয়ার্ড করছে ম্যাসেজটাকে। আমাকে আজকে অনেকেই ম্যাসেজটা ফরোয়ার্ড করেছে বিরক্ত হয়ে সবাইকে এসব ফালতু ম্যাসেজ ফরোয়ার্ড করতে নিষেধ করেছি। ফালতু বলার কারণ হচ্ছে এই ম্যাসেজটা একটা প্রোপাগাণ্ডা এবং জঘন্য মিথ্যাচার। সোজা কথায় বললে, করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে একটা দল।

একটা হাসপাতালে তিন চারটা রুগী মারা যাচ্ছে অথচ কেউ জানছে না অথবা সে কাউকে বলতে পারছে না এটা কোন কথা হলো? ম্যাসেজদাতা ডাক্তার প্রথমে বলছেন , এক সপ্তাহে দুইজন মারা গেছে। এরপরে তিনি বলছেন অনেক রুগী মারা গেছে। এর একটু পরে তিনি অনেক রুগীর সংখ্যা বোঝানোর জন্য আঠারো আর উনিশ সংখ্যাটাকে হাজির করেছেন। আবার তার বলার ভঙ্গি শুনে সন্দেহ হয়েছে। এবং মনে হয়েছে যে, সামনে একটা কাগজ আছে সেই কাগজ পড়ে পড়ে সব রেকর্ড করছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এটা কি কলির যুগ? কিম্বা এটা কি আঠারো কিম্বা উনিশ শতক? আজকে আফ্রিকার জঙ্গলে একটা মানুষ মারা গেলেও তো সেটা সবাই জেনে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে সুদানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা গুহায় সুদানের সাবেক সেনাপ্রধানের জীবিত কংকাল পাওয়া গিয়েছে। সেই খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় স্রোতের বেগে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে অথচ চিটাগংয়ের মতো একটা জায়গা যেটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী সেখানে আঠারো উনিশজন করোনা ভাইরাসে মারা গিয়েছে সেটা প্রকাশ পাবে না? আঠারো উনিশজন যেখানে মারা যায় সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা থাকার কথা তো হাজার হাজার কিন্তু আমার পরিচিত চিটাগংয়ের কেউ এ পর্যন্ত আক্রান্ত হননি।

এ ধরনের মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা যারা ছড়ায় তারা দেশ ও জাতির দুশমন। সমগ্র জাতির দুঃসময়েও এরা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে স্রোতের বিপরীত চলছে। গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন যারা কর্মকর্তা আছেন আশা করছি আপনারা এদিকটায় একটু নজরদারি করবেন। এটা ঈমানী দায়িত্ব। একটা মহামারী কিম্বা রোগ জাতীয় সমস্যা যখন আসে তখন সেটা দেখার দায়িত্ব শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের না, সবগুলো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে পড়ে। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে সবচেয়ে বেশি। উন্নত দেশগুলো করোনা ভাইরাসের কারণে সেল তৈরি করেছে। গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। কারণ আজকাল মানুষ গুজব খুব খায় বিশেষ করে আমাদের বঙ্গ দেশের মানুষেরা।

”কান চিলে নিয়ে গেছে” এই প্রবাদ প্রচলিত শুধু আমাদের বঙ্গ দেশের মানুষের জন্যই। আজকাল ঘরে ঘরে ফেসবুক। অজপাড়াগাঁয়ের নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যদেরও এখন ফেসবুক আছে। বাটন সেট দিয়ে ফেসবুকিং করছে। কোন নিউজ আসলে সেটা ঘরের সবাইকে পড়ে শোনানো হচ্ছে। এবং এইসব নিউজকে অধিকাংশ মানুষই সত্য মনে করছে। ডাক্তারের পরামর্শের থেকেও বেশি কাজ করছে এসব নিউজ। কিছুদিন আগে থানকুনির পাতা খাওয়ার নিউজ এই ফেসবুকেই ভাইরাল হয়েছে। প্রসেসিং ছাড়া অনেকে মুঠো মুঠো ভরে পাতা খাওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

বাবরি মসজিদের রায়কে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন আগে দুষ্ট প্রকৃতির ধর্ম ব্যবসায়ীরা এরকম একটা ম্যাসেজ ফরোয়ার্ড করেছে। সেই ম্যাসেজের ভাষ্য ছিলো, ভাই, আমি ইব্রাহিম মাহফুজ । আমরা মুসলমান। আমাদের সেজদার জায়গায় মন্দির হোক সেটা আমরা চাই না। বাবরি মসজিদের জায়গায় মসজিদ হবে না কি মন্দির এই বিষয়ে ইন্ডিয়ায় ভোট হচ্ছে এবং এই ভোটের ফলাফল হাইকোর্টে পাঠানো হবে।আমাদের ভোটের খুব প্রয়োজন। তো আমরা এই কারণে ফেসবুকে ভোটের আয়োজন করছি। সুতরাং আপনি যদি মুসলমান হন তাহলে শেয়ার করুন। আপনারা যতবার শেয়ার (ফরোয়ার্ড) করবেন, সবগুলো ভোট হিসেবে গণ্য হবে।

এই ম্যাসেজটা আমার আদরের একটা ছোটভাই আমাকে পাঠিয়েছে। প্রতিত্তরে আমি তাকে রিপ্লাই দিলাম, এসব ফাউল জিনিস শেয়ার করবা না। এই শেয়ারের মাধ্যমে তারা ব্যবসা করছে। যত বেশি শেয়ার হবে ততবেশি ওরা টাকা ইনকাম করবে। ওরা ধর্ম ব্যবসায়ী। খুবই ভয়ংকর। মুসলমানদের কোন উপকার নেই। এই ম্যাসেজের মাধ্যমে তারা বিশৃঙ্খলা তৈরি করার চেষ্টা করছে। শান্তির ধর্ম ইসলামে কোনোভাবেই দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অনুমতি দেয় না বরং যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে তাদের জন্য ভয়াবহ শাস্তির কথা রয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালায়, নিশ্চয় তাদের সমুচিত শাস্তি হলো নৃশংসভাবে তাদেরকে হত্যা করা বা ক্রুশে দিয়ে মারা অথবা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা কিংবা তাদেরকে নির্বাসিত করা। এটা হলো তাদের জন্য ইহকালের লাঞ্ছনা এবং পরকালেও রয়েছে তাদের জন্য এক মহা আজাব’ (সূরা আল মায়েদা : ৩৩)

কুরআন পাকের এই কড়া হুঁশিয়ারির কারণে আমার সেই ছোটভাই তওবা করেছে যে, আর কখনো এসব ম্যাসেজ ফরোয়ার্ড করবে না। আজকাল ফরোয়ার্ডের মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। আর বাংলাদেশে যারা ফেসবুক ইউজ করে তার আশি পার্সেন্টই হচ্ছে অসচেতন। আমার ধারণা, বার্সা কিম্বা রিয়াল মাদ্রিদের পেইজের একশো মিলিয়ন লাইকের মধ্যে বিশ মিলিয়ন মিলিয়ন লাইক শুধু আমাদের বাংলাদেশের মানুষের আর বাদবাকি লাইক অন্যসব মহাদেশের মানুষের। এতোটা হুজুগে আমরা। ধর্ম ব্যবসায়ীরা এই অসচেতনার সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে।

ধর্মের নামে এরা মানুষের মাইন্ড নিয়ে খেলা করে যার কারণে প্রোপাগাণ্ডা ছড়াচ্ছে বেশি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে এরা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করে। তৌহিদি জনতা নামে এরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে দেশ ও জাতির। রাতের অন্ধকারে তৌহিদি জনতা শিরোনামে পোষ্টার লাগিয়ে বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা তৈরির পায়তারা করেছে। ইদানীং তৌহিদি জনতা শিরোনামের গুজব গোষ্ঠীগুলো ফেসবুকে সক্রিয়। এমন পরিস্থিতিতে গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা বাড়ানোর খুবই দরকার বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কথিত ইব্রাহিম মাহফুজ এবং রুহানকে উপদেশদাতা চিটাগং মেডিকেলের সেই দুষ্টু, মিথ্যুক ডাক্তারকে গ্রেফতার করা সময়ের দাবি এবং এর পিছনে কলকাঠি কারা নাড়ছে সেটাও বের করা দরকার।

সাথে সাথে দেশপ্রেমিক জনগণকেও এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। না জেনে না বুঝে ম্যাসেজ ফরোয়ার্ড কিম্বা শেয়ার করবেন না। এদেরকে রুখে দাঁড়ান। আল্লাহ পাক আমাদেরকে হেফাজত করুন।
লেখক : গল্পকার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *