৫ই জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ , ২২শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ , ১৫ই জিলকদ, ১৪৪৪ হিজরি
শীতের শেষ রাতে খোদাপ্রেমিকদের জিকিরের আওয়াজ এবং রোনাজারিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে কী প্রার্থনা! ‘ও মালিক! ও মালিক!’ বুকফাটা কান্না সকলের। পুরো ময়দানের কারো চোখ যেন শুষ্ক নেই। অঝোরধারায় অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। কারো হেঁচকি উঠছে। নিজের মনের আকুতি পেশ করে চলেছে। সকলে মহান প্রভুর দরবারে ক্ষমা চায়। মনে হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা কাউকে বঞ্চিত করবেন না। সকলকে রহমতের চাদরে আবৃত করে নিবেন। কেননা এ এমন রোনাজারি, এমন ফরিয়াদ, এমন তওবা-ইস্তেগফার তাতে মহান প্রভু কাউকে মাহরুম করবেন না সেই আশা করাই যায়।
এ দৃশ্য স্বচক্ষে দেখলাম। কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানাধীন বেলঙ্কার নিভৃতপল্লি ‘জামিয়াতুল ইসলাহ ময়দানে’, যেখানে ফিদায়ে মিল্লাত রহ.-এর খলীফা আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দামাত বারাকাতুহুম-এর আহ্বানে প্রতিবছর তিনদিন ব্যাপি ইসলাহী ইজতেমা বসে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সেখানে ওলামায়ে কেরাম এবং দ্বীনদার লোকেরা জমা হয়ে থাকে। কিশোরগঞ্জের তাড়াইল ঢাকা থেকে বেশ দূর। তারপরেও সেখানে আশেকানদের ভিড়। বিশেষ করে আলেম-উলামাদের জমায়েত ছিল চোখে পড়ার মতো। এবছর ইজতেমাতে হাজারো ওলামায়ে কেরাম জমা হয়েছিলেন। যারা দেশের বিভিন্ন মাদরাসার শাইখুল হাদীস, মুহাদ্দিস, মুহতামিম। আর জনসাধারণের তো হিসাবই করা যায় না।
জামিয়াতুল ইসলাহ-এর বিশাল ময়দান জুড়েই দৃষ্টিনন্দন প্যান্ডেল করা হয়েছিল। পুরো ময়দান ছিল ঐসকল খোদাপ্রমিকদের দখলে। যারা তিনদিন নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে ইজতেমার ময়দানের আমলে শরীক থেকেছেন। একদম যেন টঙ্গীর তুরাগতীর আর কীর্তনখোলার তীরের ইজতেমার দৃশ্য ভেসে উঠল সেখানে। মনে হতে লাগল এটা যেন তুরাগতীরের ইজতেমার দৃশ্য। কখনো মনে হল, এটা কীর্তনখোলার তীর ‘চরমোনাই’ বা চাঁদপুরের ‘উজানী’-এর ময়দানের দৃশ্য।
বেলঙ্কাতে যখন বয়ান হয়, খুঁটিভিত্তিক তালিম হয়, সুরা-ক্বেরাতের মশক হয়, মনে হয় এটা তুরাগতীরের ইজতেমা। আবার যখন জিকির হয়, মুনাজাতে আশেকানদের কান্নাকাটি করতে দেখা যায়, তখন মনে হয় এটা কীর্তনখোলার তীরের চরমোনাই ময়দান। বলতে গেলে, এক অভূতপুর্ব দৃশ্য দেখলাম বেলঙ্কার ইজতেমাতে।
সবচেয়ে ভাল লাগে, যখন শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব বলেন, ‘এই ইজতেমা ওয়াজের জায়গা নয়, এটা আমলের জায়গা। আমল শেখার জায়গা।’ সত্যি সেখানে আমলের মজলিস বসে। ওয়াজের আকর্ষণ নেই সেখানে। রংঢং বা হম্বি-তম্বি করার কোনো বক্তা সেখানে নেই। কোনো হাসি-তামাশা বা ওয়াজ বিনোদন সেখানে হয়না। সেখানে আমলের পরিবেশ কায়েম করা হয়েছে।
আজকাল তো ওয়াজ মাহফিলে রঙ-তামাশা করা বক্তা যাকে বলে কমেডিয়ান, আর হম্বি-তম্বি করা বক্তাকে তালাশ করা হয়। যেন স্রোতাদের দীর্ঘ সময় আটকে রাখা যায়, ময়দানে যাতে উপচেপড়া ভিড় থাকে। বড় গ্যাদারিং হয়। এরকম নানান ভ্রান্ত চিন্তা নিয়ে আয়োজকগণ বক্তাদের সেটিং দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাড়াইলের ইজতেমাতে সেসব কোন বক্তা বা সেধরনের সিষ্টেম চোখে পড়ল না। বরং এক আমলী পরিবেশ সেখানে কায়েম হয়েছে। হাজার হাজার জনতা সে আমলে এবং ইসলাহী প্রশিক্ষণে শরীক হয়েছিল।
ফজরের এক ঘন্টা পুর্বে তাহাজ্জুদের আমল। নামাজ শেষে ১২ তাসবির জিকির এবং দুআ-মুনাজাত। বাদ ফজর সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত। এরপর ৬ তাসবির জিকির। তারপর ইসলাহী বয়ান। বয়ানের পরে নাস্তা শেষ করে খুঁটিওয়ারী তালিমের ব্যবস্থা প্রায় বারোটা পর্যন্ত চলে। মানুষকে কোরআন শিক্ষা দেওয়া হয়। আমলের মশক করানো হয়। নামাজের প্র্যাক্টিক্যাল ট্রেনিং দেওয়া হয়। কীভাবে রুকু করবে, সেজদা করবে, নামাজে কীভাবে দাঁড়াবে, হাত বাঁধা ইত্যাদি বিষয়াদি আলেমদের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয়। বাদ আসর বয়ান, দরুদ শরীফের আমল। বাদ মাগরিব সুরা ওয়াকিয়ার আমল ও ৬ তাসবিহের জিকির। বাদ এশা কিতাবী তালিম। অবশ্য ফাঁকে ফাঁকে আলেমদের ইসলাহী বয়ান রয়েছে। ইজতেমার দ্বিতীয় দিন ছিল আলেমদের উদ্দেশ্যে বিশেষ বয়ান। আবার পর্দানিশিন মহিলাদের জন্য বিশেষ তালিমের ব্যবস্থা।
মোটকথা, তাড়াইলের ইজতেমা আমলের ইজতেমা। এতে স্মরণ হয় তুরাগতীরের ইজতেমা আর কীর্তনখোলার তীরের ইজতেমার কথা। মনে হয় ওসব জায়গার সবরঙ এখানে ছড়িয়েছে, সব নূর এসে জমেছে এখানে। কেননা সবার গোড়াপত্তন তো একই জায়গাতে। একই গাছের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে। মুলে তো রয়েছেন সেই ফকীহুন নফস, কুতুবে রব্বানী রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহি (রহ.)। যার শেকড় প্রোথিত দারুল উলুম দেওবন্দের সাথে। রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহি (রহ.)-এর এক খলীফা শাইখুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.)। আরেক খলীফা হযরত খলিল আহমাদ সাহারানপুরী (রহ.)। আরেকজন উজানীর হযরত ক্কারী ইব্রাহিম (রহ.)।
উজানীর শাখা হলো চরমোনাই। সাহারানপুরী (রহ.)-এর খলীফা হলেন ইলিয়াছ (রহ.), যেখান থেকে দাওয়াত ও তাবলীগের শাখা বের হয়েছে। আর শাইখুল ইসলাম মাদানী (রহ.) এর খলীফা ফিদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী (রহ.)। যাঁর অন্যতম একজন খলীফা হলেন শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দামাত বারাকাতুহুম। সুতরাং বেলঙ্কার ইজতেমা থেকে তো টঙ্গীর তুরাগ তীরের ইজতেমা আর চরমোনাই ময়দানের ঘ্রাণ আসবেই। এর সবগুলোর শেকড় দারুল উলুম দেওবন্দের সাথে মিশে আছে।
বড় মোবারক ইজতেমা হয়ে গেল তাড়াইলের বেলঙ্কাতে। আকাবির-আসলাফের ধ্বনি আবার যেন বেজে উঠল প্রিয় শায়েখ ও মুর্শিদ শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবের কন্ঠে; যারা ছিলেন সাহাবায়ে কেরামের উত্তরসুরী। আর সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর বৈশিষ্ট ছিল ‘ফুরাসান ফিন্নাহার ও রাহবানান ফিল লাইলে’-অর্থাৎ রাতে তাঁরা ছিলেন সন্নাসি-বৈরাগি দিনের বেলায় অশ্বারোহী সৈনিক। আমাদের পূর্বসূরীগণ সেই মেযাজ নিয়ে চলেছেন। যে ইজম নিয়ে কাজ করেছেন দেশ ও জাতির মাঝে, বর্তমান সেই পথের অন্যতম অনুসারী এক ব্যক্তিত্ব আল্লামা মাসঊদ। মানুষকে ইসলাহ বা সংশোধনের মাধ্যমে খোদার রাহে পরিচালিত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা তাঁর। জাতির ক্রান্তিকালে আকাবিরে দেওবন্দের অনুগামী হয়ে বুক চিতিয়ে দিচ্ছেন। এমন লিল্লাহিয়্যাত কাজের মানুষ এই জামানাতে কমই মিলবে।
পরিশেষে আল্লামা মাসঊদ সাহেবের জন্য প্রাণখুলে দুআ করি। আল্লাহ তাঁকে নেক হায়াত দান করেন। আমিন।
লেখকঃ শিক্ষক ও কলামিস্ট