২৬শে জুন, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই আষাঢ়, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ , ২৫শে জিলকদ, ১৪৪৩ হিজরি
মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে প্রায় তিনমাস হতে চললো। সরকারি হিসাবানুযায়ী সাড়ে ছয়লাখের মতো হলেও এর প্রকৃত সংখ্যা প্রায় দশলাখের কাছাকাছি। বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার শুরু থেকেই বাস্তুচ্যুত এ জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছে সর্বাত্মকভাবে। লাখ লাখ মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার পুরোপুরি ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ।
সাময়িকভাবে আশ্রয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠনেও বাংলাদেশ এককভাবে কাজ করছে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও অব্যাহত আলোচনার মাধ্যমে এখন সসম্মানে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশী সাধারণ জনগণ শুরু থেকেই সর্বাত্মক সহায়তা করেছে।
বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিপন্ন এ জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছে সবাই। জাগতিক কোন লাভ বা মুনাফার আশায় নয়, মানবতার সঙ্কটকালে মনুষ্যত্যের প্রেরণাই সবাইকে উৎসাহিত করেছে এ মহৎ কাজে। কুতুপালং, বালুখালী, থ্যাইংখালী, নয়াপাড়ার ক্যাম্পগুলোতে শতশত তরুণ –যুবক কাজ করেছে মানবতার টানে। মানবসেবায় উৎসর্গিত সবার প্রতি রইলো আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা।
আমি আজ লিখবো আমার খুব কাছ থেকে দেখা একজনকে নিয়ে। রোহিঙ্গাক্যাম্পে যিনি অবিরাম কাজ করছেন শুরু থেকেই। একটি সময় পর্যন্ত কুতুপালং ও টেকনাফের দিকে অনেকের যাতায়াত ছিলো, কিন্তু এখন আর তেমন আনাগোনা হয় না। বিভিন্ন সংস্থাও কয়েকবার যাতায়াতের পরই নিজেদের দায়িত্ব সম্পন্ন করে ফেলেছে। কিন্তু আমাদের প্রিয় সদরুদ্দীন মাকনুন ভাই, প্রথমেই টার্গেট নিয়েছেন শেষ সময় পর্যন্ত কাজ করার। খুব হুড়োহুড়ি ও আনুষ্ঠানিকতা করে একবারেই অনেক কাজ করে ফেলার পক্ষে তিনি ছিলেন না। সীমান্তে যখন রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছিলো, অন্যান্যদের দেখে আমরা অনেক কিছুই ভাবতাম।
বিভিন্ন সংস্থার দৌড়ঝাঁপ দেখে নিজেদের কাজকে খুবই কম মনে হতো। মাকনুন ভাই তখন বলতেন, দেখো, শেষ পর্যন্ত কারা মাঠে থাকে। তারাই বেশী কাজ করবে। এ সপ্তাহে যখন ৪র্থ বারের মতো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেলাম, মাকনুন ভাইয়ের কথাটা ভালোভাবেই উপলদ্ধি করলাম।
মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুনের পরিচয় নতুন করে দেওয়ার প্রয়োজন মনে হয় নেই। আকাবিরে দেওবন্দের তরজুমান আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দা.বা. এর জ্যেষ্ঠ তনয় মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুন। ফরীদ সাহেব হুজুরের চিন্তা ও কর্মপন্থার সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মকে তিনি নতুনভাবে পরিচিত করাচ্ছেন। আশির দশকে লাজনার ব্যানারে বুদ্বিবৃত্তিক যে আন্দোলন হয়েছিলো, ঝিমিয়ে পড়া সে আন্দোলন নতুনভাবে জাগ্রত করার স্বপ্ন দেখেন আমাদের মাকনুন ভাই। নবীন-প্রবীণের সমন্বয় তিনি করতে পারেন খুব দক্ষতার সঙ্গেই। রোহিঙ্গাদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কাজের পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রতিনিধিসহ বিশ্বের বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা কাজ করছে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা ও ইসলাহুল মুসলিমীন পরিষদের হয়ে।
আওলাদে রাসূল (সা.) মাওলানা সাইয়্যেদ মাহমুদ মাদানী ও মাওলানা আফফান মানসুরপুরী দা.বা. রোহিঙ্গাদের দেখতে এসেছিলেন। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সেক্রেটারী মাওলানা হাকিমুদ্দীন কাসেমী ও অর্গানাইজার মাওলানা আহমদ আবদুল্লাহ প্রায় দু সপ্তাহ থেকেছেন বাংলাদেশে। কুতুপালং থেকে শুরু করে নাফনদীর তীরের শাহপরী দ্বীপ পর্যন্ত মাকনুন ভাই তাদেরও ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। শাহপরীর দ্বীপে একরাত তাদের সঙ্গে আমারও থাকা হয়েছিলো। খুব কাছ থেকে দেখেছি তাদের কর্মতৎপরতা।
বিপন্ন মানবতার জন্য তাদের দরদ আমাকেও অস্থির করে তুলেছিলো। এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আমার চারবার যাওয়া হয়েছে। বিভিন্নভাবে যারা কাজ করেছে তাদের অনেকবারই যাতায়াত হয়েছে। কিন্তু আমাদের মাকনুন ভাই নিজেও জানেন না, এ পর্যন্ত মোট কয়বার তার যাতায়াত হয়েছে। সপ্তাহর পর সপ্তাহ তিনি কক্সবাজার থেকে কাজগুলোর তদারকী করছেন। এ পর্যন্ত প্রায় হাজারের উপর শেড নির্মিত হয়েছে জমিয়তুল উলামার তত্ত্বাবধানে। শুরু থেকেই খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। কয়েকদফায় চিকিৎসাক্যাম্পও বসানো হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার পরিকল্পিত কাজের প্রশংসা করেছে। কাজের চেয়ে বেশী প্রচার বা শুধু প্রচারনির্ভরতার প্রতি বরাবরই মাকনুন ভাইয়ের অনাগ্রহ। তিনি যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন, ঢাকায় আমরা তার জীবনাচার যেমন দেখেছি, সে হিসেবে কক্সবাজার থাকাটা তার জন্য কিছুটা কষ্টকরই ছিলো।
কুতুপালংয়ের আঁকাবাঁকা পাহাড়গুলো এখন মাকনুন ভাইর খুব পরিচিত। অনায়েসেই তিনি উঠে যাচ্ছেন সরু পাহাড়গুলোতে। পাহাড়ে চলার জন্য পাহাড়সমান হতে হয়। মাকনুন ভাই যেনো সত্যিই পাহাড়সম উদারতার প্রতীক। পাহাড়ের সঙ্গে যেন অনেক দিনের সখ্যতা।
মাকনুন ভাই সবসময় একটা কারগুজারি শোনান, শাহপরীর দ্বীপ প্রথম দিন যাওয়ার সময় মাঝপথে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। একসাথী বললেন, আর যাওয়া ঠিক হবে না। হাকিমুদ্দীন কাসেমী সাহেব বললেন, আজ যদি আমরা ফিরে যাই, ইতিহাসে লেখা হবে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের কর্মীরা মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছে। মাঝপথ থেকে ফিরে আসার ইতিহাস জমিয়তের নেই। মাকনুন ভাইকে আমীরে ফায়সাল বানানো হলো, তিনি সিদ্বান্ত দিলেন, আমরা যাবোই। প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যেও সেদিন তারা শাহপরীর দ্বীপ গিয়েছিলেন। মাকনুন ভাইকে দেখে আমরা প্রেরণা পাই, উৎসাহিত হই। সদরুদ্দীন মাকনুন তারুণ্যের আইডল, তার মতো বিরাট মনের যুবকরা আছে বলেই আমরা এ বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আপন করে নিয়েছি।
দীপ্তকণ্ঠে বলেছি, প্রয়োজনে একবেলা খাবো, আরেকবেলা রোহিঙ্গাদের খাওয়াবো। সদরুদ্দীন মাকনুন ভাই খুব বড় কেউ নন, তিনি বাংলাদেশেরই একজন যুবক। যারা প্রতিনিয়ত সত্য ও সুন্দরের পক্ষে কিছু করার তাগাদা অনূভব করে। এমন তরুণ-যুবকরা আছে বলেই আমরা এক নতুন দিনের স্বপ্ন দেখি।ছোট্ট করে কেবল একটা কথা বলে রাখি, রোহিঙ্গাদের সেবায় বাংলাদেশে যত সংস্থা দান-অনুদান দিযেছে এরমধ্যে সেনাবাহিনীর তালিকায় তারুণ্যের অহংকার মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুনের তত্ত্বাবধানে প্রদানকৃত অনুদানের হিসাব ইউনিসেফের পরই তার অবস্থান।
লেখক: তরুণ আলেম ও চিন্তক