সাঁকোর নিচে শান্তজল হোসাইন কবির
মুস্তাফা জামান আব্বাসী : বইটি হাতে পেয়েছি দু’দিন। দীর্ঘ বিরতির পর হোসাইন কবিরের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক একজন কাব্যদেবীর দোল খেলানো স্বতন্ত্র কাব্যস্বরের কবি। প্রকাশক খড়িমাটি। কি করে পেলাম বইটি সে এক কাহিনী। প্রথম কবিতাটি রাতকে রাত মনে হয় না, পাথরের নদী চোখে পড়ে নীরব চাঁদ ভরা জোছনায়।
আমি কাব্য পাঠক, তবে সিজনাল বলতে যা বোঝায়, তাই। অর্থাৎ যখন আমি কবি, তখন আমি কাব্য পাঠক। যখন আমি কাব্য পাঠক তখন আমি কবির চাইতেও রোমান্টিক। কবিও তার শেষ সীমানায় পৌঁছুতে পারেন নি। কেন এমন হয় তা বলতে পারব না। যেমন রবীন্দ্রনাথের বকুল বলতেই সারা বকুল গাছে আমার সামনে খেলা করে। ছোট ছোট ফুলগুলো গন্ধ ছড়ায় সারা দিন রাত, আর অল্প বাতাসেই সমস্ত গাছের পাতাগুলো একে অপরের উপর নুয়ে পড়ে, যেন কি এক বিস্ময়ে সবাই সবাইকে স্পর্শ করতে চাচ্ছে। সেই সঙ্গে বকুল ফুলের গানগুলো কেমন হবে ভেবে দেখুন। নিশ্চয় একেকটি গান, একেকটি কবিতা অপার্থিব।
হোসাইন কবিরের শেষ কবিতাটা নিয়ে যাত্রা শুরু করি। পড়ুন।
উপলব্ধি
‘যে কোন দিকেই তুমি যেতে পারো কিংবা স্থির দাঁড়িয়ে থেকে নিজের উপস্থিতির পক্ষে দু’চারটে কথাও স্বাধীনভাবে বলতে পারো, কারণ তুমি তোমার মতই সুন্দর উপভোগ করো কিংবা নিষেধের অর্গল ভেঙে অবগাহন করো সুন্দরে অথবা অসুন্দরে, আর ভালোবাসো চারপাশের বিষয়বস্তু জড় কিংবা জীব।
আসলে তোমার আমার দ্বিতীয় কোন পক্ষ নেই; তোমার আমার নিজের বলেও কিছু নেই, ছিলো না কিছুই, না ছিলো পক্ষ, না ছিলো বিপক্ষ। যে অতীতকে তুমি আমি ধারণ করতে চাই; যে ইতিহাস ঐতিহ্যকে নিজের একান্ত অধিকারের বস্তু বলে ভাবা হয়, সবই সীমাবদ্ধ সময়ের হিসেব নিকেশ।
আসলে মহাকাল ভাবনায়, মহাকালের পুনর্বিন্যস্ততায় তুমি আমি আলোকিত হবো কিংবা শূণ্যগর্ভে মিলিয়ে যাবো!- কোন এক নতুন পৃথিবীতে, কোন এক নতুন আকাশের ছায়ায় কিংবা কোথাও নয়।’
এই গদ্যটি পড়ার পর কেউ যদি আনমনা হয়ে অন্য এক পৃথিবীর সন্ধানে সাঁকোর নিচের শান্তজল পেরিয়ে উড্ডীন অন্যকোন জগতে, মন্দ হয় না।
কয়েকটি কবিতা আমার কাছে অপূর্ব মনে হয়েছে। যেন কোনদিন এ রকম কবির মুখোমুখি হয় নি যে বৃক্ষ সন্তানকে দেখেছে রাত জাগা পাখি হিসেবে। আর মানব-মনবী সব বৃক্ষের সন্তান।
কবিতা আসলে নগ্নঠোঁট শুয়ে আছে সাবওয়ে রেলপাতের সমান্তরাল নিশি জাগা ট্রেন ছুটে চলে, হুইসেল বাজে, বিস্তারিত অলীক গল্পবুনন শূণ্যতায় কিসের পতন। এমনি কয়েকটি শব্দ এক করলে হয়ে যায় পুরাতন মাদুলি। আসলে রূপকল্প যখন চোখের সামনে আসে তখন পাঠকই রচনা করতে পারে কবিতার পর কবিতা। তখন ইলশা ঘাটে তোমার আমার দেখা হয়ে যায়। তুমি আমার চির পরিচিত অজানা বাংলার মেয়ে। হঠাৎ এখানেই তোমার সঙ্গে দেখা হবে এমন তো কথা ছিল না। অথচ পদ্মা নদীর মাঝি অথবা অনেক মানিক বন্দোপাধ্যায়কে ফেলে এসেও তোমার দেখা পাই নি।
এই ছোট্ট বইটি অনেক স্বপ্ন চোখে আনে, অনেক অপূর্ণ ইচ্ছা, স্বাদ এনে দেয় পথের সামনে যা কোনদিন পূরণ হওয়ার নয়। নীল প্রচ্ছদে আছে অনীল কামনা। সর্বনাশী কোথাও একটা কিছু পুড়ছে সঙ্গোপনে, আমরাও পুড়ছি, কিছু একটা ঘটবে। নরোম কাদায় আলপথে খুঁজতে গিয়ে আসে এক নারী। তার পরিচয় শুধু সেই জানে।
হোসাইন কবিরের কবিতা আনে অপূর্ব স্বপ্ন, যে স্বপ্নরা অল্প দোলাতে ভেঙে যায়, আবার নতুন স্বপ্ন আনে। এমন কবিতা সত্যি দুর্লভ।
মু. জা. আ.
৩০শে বৈশাখ, ১৪২৬