- আমিনুল ইসলাম কাসেমী
আমি ব্যর্থ। এ বইয়ের রিভিউ লেখা সম্ভব নয়। ‘আল্লাহর পরে শ্রেষ্ঠ যিনি’—আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব রচিত সীরাতগ্রন্থ। যেভাবে তিনি ভাষার অলংকারে সাজিয়েছেন, যেসব শব্দের গাঁথুনি দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারিত্রিক গুণাবলি তুলে ধরেছেন—ও সম্পর্কে কিছু লেখার এবং কলম ধরার শক্তি-সাহস কোনোটাই আমার নেই।
যেমন পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে এক কবি বলেছেন,
লা ইউমকিনুছ ছানাউ কামা কানা হাক্কহু
বাদ আয খোদা বজুর্গ তুঈ কিসসা মুখতাসার“সম্ভব নয় বলা তাঁর ছানা ও সিফাত,
খোদার পরে তুমিই শ্রেষ্ঠ সংক্ষেপে মোরা এই তো জানি”
তেমনি আল্লামা মাসঊদ সাহেব যে অনুপম ভাষায় তাঁর গ্রন্থে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনচরিত ফুটিয়ে তুলেছেন, এর সারসংক্ষেপ লেখা আমার মতো মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনচরিতের উপর এক অতুলনীয় গ্রন্থ তিনি দাঁড় করিয়েছেন, যার আদ্যোপান্ত আশেকে নবীদের খোরাক, যার পরতে পরতে নবীপ্রেম জাগ্রত হয়, যে লিখনী পড়ে পাঠক বিমুগ্ধ হবে, ভালবাসার অত্যুঙ্গ শিখরে কখনো পৌঁছে যাবে; সেটা বলা যেতে পারে।
কী লিখবো বলুন তো? বাংলাভাষার একজন সুপণ্ডিত এবং মুহাক্কিক আলেম তিনি। নির্ভরযোগ্য সীরাতগ্রন্থ এবং হাদীসে নববী থেকে আহরিত তথ্য-উপাত্ত, সুষম শব্দের ব্যবহার, হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপনা, বিশেষ করে পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বৈশিষ্টগুলো বর্ননা দিতে গিয়ে যেসব উচ্চাঙ্গের ভাষা-শব্দ তিনি বসিয়েছেন, তাতে বারবার আমাকে অভিধানের স্মরণাপন্ন হতে হচ্ছে। আর বিষয়টা এমন, যে মহামানবের বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ননা করা হচ্ছে, তাঁর জন্য এসব ভাষা ব্যবহার না করলে তাঁর গুণাবলী কখনো ফুটে উঠবেনা। এজন্য সন্মানিত লেখক যথাযথ ভাষার মাধ্যমে উচ্চাঙ্গের সাহিত্যের প্রকাশ ঘটিয়ে নবীজীর জীবনী লিখেছেন।
তবে এটি জটিল বা দুর্বোধ্য কোনো গ্রন্থ নয়। সব ক্ষেত্রে প্রাঞ্জলতা এবং কোমলতার পরশ রয়েছে। একজন খাঁটি নবী প্রেমিক অতিসহজেই বিষয়টা অনুধাবন করতে পারবেন। পড়তে পড়তে হৃদয়-গহীনে নবীপ্রেম জমা হবে। ভালবাসার উচ্চমার্গে পৌঁছে যাবেন পাঠকমাত্রই।
বইটি পড়ে যেটা অনুভব করছি, এই জ্ঞানভান্ডার, এই শব্দমালা, এই ধরণের উপস্থাপনা যেনতেন ব্যক্তির দ্বারা সম্ভব নয়। পেয়ারা নবীর এই ‘রূপময় কান্তি’ তুলে ধরার শক্তি সাধারণ কোন লেখকের কলমেও আসবেনা। কেননা এটা সাধারণ কোন লিখনী নয়। এটা রাহমাতুল লিল আলামিন এর জীবন-চরিত। সুতরাং খাঁটি নায়েবে নবী এবং নবীপ্রেমে দেওয়ানা হওয়া ছাড়া কারো পক্ষে তা সম্ভব নয়।
একজন লেখক; কখন তার কলম থেকে ভাষার মাধুর্য ও শব্দের ঝংকার নির্গত হয়? যখন লেখকের হৃদয়ে ভালবাসার সাইক্লোন জন্ম নেয়, তখনি কলমের আঁচড়ে উঠে আসে ভাষার অলংকার। তদ্রূপ আল্লামা মাসঊদ সাহেবের পেয়ারা নবীর প্রতি কী সীমাহীন ভালবাসা, কী যে প্রেম, কী মায়া, কী যে ভক্তি—সেটা এই সীরাতগ্রন্থটির মাধ্যমে অনুমান করা যায়। তাঁর এই লিখনী দ্বারা আন্দায করা যায়, সত্যিই তিনি খাঁটি নায়েবে নবী এবং আশেকে রাসূল।
আসলে পেয়ারা হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে চূড়ান্ত কিছু লেখা সম্ভব নয়। শারীরিক গঠন ও স্বভাবচরিত্র—উভয় সৌন্দর্যে পরিপূর্ণতায় পূণ্যময় ছিলেন তিনি। আজ পর্যন্ত কোনো কলমসৈনিক তাঁর ব্যাপারে চূড়ান্ত কিছু লিখে যেতে পারেনি। সকলেই নিজের অক্ষমতা- দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন এবং সকলে এই কথার উপরে ঐক্যমত্য, আল্লাহর পরে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ।
তদ্রূপ আল্লামা মাসঊদ সাহেব নিজেও পেয়ারা হাবীবের জীবন-চরিত লেখার ব্যাপারে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন। বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপে উল্লেখ করেছেন—
“কেমন করে আঁকা যায় সেই রূপময় কান্তি, যা অনুভবময় হয়েও অনুভবের ঊর্ধ্বে, স্পর্শময় হওয়ার পরও পরশ করা যায় না যাঁকে, অঙ্গময় হওয়ার পরও আঙ্গিক কাঠামো যাঁর বর্ণনার ঊর্ধ্বে, স্নিগ্ধ বর্ণময়তার শোভায় পিছলে যায় চোখ যাঁর দর্শনে! সমস্ত উপমা যেখানে হারায় তার উপমেয়তা, তুলনা যেখানে অতুলনীয় বলেও হয় না বলার শেষ।
বলো, কেমন করে আঁকা যাবে সেই কান্তিময় নাসিকাগ্রের নূর, দর্শকের যেখানে ঘটতো দৃষ্টিবিভ্রম, যাতে তাঁর নূরময় নাসিকা আরো, আরো একটু উঁচু মনে হতো! বাণী নির্ঝরনীর সময় সেই শিশির-পিছল স্ফটিক দন্তরাজির ফাঁকে ফাঁকে অঙ্গহীন গড়িয়ে পড়তো পবিত্র মুখগহ্ববরের স্ফুলিঙ্গ, আভাময় দীপ্তি, কেমন করে আঁকবে তাঁকে!
…আঁকা গেলো কি? তিনি তো ছিলেন ‘খালকান’ ও ‘খিলকাতান’ শারীরিক গঠন ও স্বভাবচরিত্র উভয় সৌন্দর্যেরই পরিপূর্ণতায় পূর্ণময়, সৃষ্ট সৌন্দর্যের সবদিক চূড়ান্ত হয়েছে এখানে, শেষ এখানেই।”
কী চমৎকার অভিব্যক্তি! বোঝা যায় প্রেমাস্পদের প্রতি কত গভীরতম ভালবাসা। এই প্রেমোপাখ্যান দু-চার দিনের প্রেমে লেখা সম্ভব নয়। বরং যুগ যুগ ধরে জমে থাকা নবীপ্রমের বহিঃপ্রকাশ এখানে তিনি ঘটিয়েছেন। এই প্রেম-প্রীতির মাঝে কোন খুঁত নেই। নিখুঁত ভালবাসা। একজন ‘খুঁতহীন সত্তার’ জীবনচরিত নিঁখুত ভালবাসায় তুলে ধরেছেন একজন খাঁটি প্রেমিক।
বড় সৌন্দর্যমন্ডিত বইটি। চমৎকার বাঁধাই। হাতে নিলে পরাণ জুড়াবে। পাথেয় পাবলিকেশন্স এবং ইকরা ম্যাপেল একাডেমী যৌথভাবে এটি প্রকাশ করেছেন। ধন্যবাদ তাদেরকে। দুআ করি, জাতির খেদমতে এমন গ্রন্থ আরো প্রকাশ করুন। দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে এই মহান খেদমতে আরো বেশী বেশী এগিয়ে আসুন। আল্লাহ তাআলা সকলের সহায় হোন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট