- আহমদ সিরাজী
সকাল থেকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আকাশের মন ভালো নেই। থেমে থেমে বৃষ্টি। পুরো দিনটাই মনমরা-মনমরা। সকাল আর বিকেলের কোনো তফাৎ নেই। উমায়ের সাদি ভাই অবেলায় গ্রামের বাড়িতে এসে উপস্থিত। শোকে মুহ্যমান হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার থেকেই জেনেছি মাদানী (আলাইহির রহমাহ)-এর আদরের ‘আব্বাসী খলিফা’ আর নেই। পরের দিন জানাযা। তখন দেশে চলছিল বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে চরম অস্থিরতা। গাড়ি চলাচল বন্ধ। সুদূর নোয়াখালী থেকে জানাজায় অংশগ্রহণ করা অসম্ভব ব্যাপার। আরেক আশেকে মাদানীকে হারালাম। শুনেছি, আল্লাহওয়ালাদের মৃত্যুতে আসমান জমিন কান্না করে। স্বচক্ষে প্রথম দেখেছি সেদিন।
আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রহমাতুল্লাহ আলাইহির) নাম প্রথম শুনি মাওলানা হাবিবুর রহমান ভাইয়ের কাছে। হাবিব ভাই মালিবাগ জামেয়ার বর্তমান শিক্ষক মুফতি লোকমান ও আরিফ ভাইদের ক্লাসমেট। নোয়াখালীর জামিয়া ওসমানিয়ায় তখন দাওরায়ে হাদীস ছিল না। হাটহাজারীতে দাওরা পড়ার রেওয়াজ ছিল। এ রেওয়াজ ভেঙে প্রথম ঢাকায় আসেন হাবিব ভাই। ওসমানিয়ায় ছাত্র হিসেবে প্রবাদতুল্য ছিলেন তিনি। ছিলেন সকলের আকর্ষণ ও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
একবার ছুটিতে গ্রামে এলে মাদ্রাসায় আসেন তিনি। তখন তাঁর কাছে এক আশেকে মাদানীর গল্প শুনি। অকপটে বলেই যাচ্ছেন। কত রঙে–কত ঢঙে! এ যেন কোনো কবির প্রেমকবিতা। এমনিতে হাবিব ভাই স্বল্পভাষী, ঐদিন মনে হলো একটু বেশিই বলছেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে বলছেন। মজলিস শেষে তার থেকে এক ফাঁকে আবারো জেনে নিলাম সেই কিংবদন্তির নাম, গেঁথে নিলাম মনের গভীরে।
২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে মালিবাগ জামিয়ায় আসি। কাজী সাহেব (রহ.) তখন এই সুস্থ তো এই অসুস্থ। হাসপাতাল থেকে আসলে মাঝে মাঝে খবর পেয়ে তাঁর রুমের সামনে উঁকি মারতাম। দরজার ফাঁক গলে এক নজর তাঁকে দেখে নিতাম। একবার সবাইকে মসজিদের দোতলায় ডাকা হয়। বোখারী শরীফ ও কোরআন শরীফের খতম হয় কয়েকবার। কাজী সাহেব হুজুরের জীবন সংকটাপন্ন জেনেই এই আয়োজন। সেদিনের দোয়ার দৃশ্য এখনো ভুলতে পারিনি। ছাত্র-শিক্ষকদের রোনাজারিতে আশপাশের বাতাস ভারি হয়ে উঠছিল। সেদিন বিকেলে খিদমাহ হাসপাতালে ছুটে গেলাম। হাসপাতালের কেবিনে আরো কয়েকজন উস্তাদের দেখা মিলল। বিনয় শব্দটির উদাহরণ এই আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রহ.)-কে দেখলাম তাঁর চিরচেনা সেই ভরাট কণ্ঠে মুফতি হারুন সাহেবের কাছে দোয়া চাচ্ছিলেন, মাওলানা, গুনাহ করতে করতে আমার পেটটা ফুলে গেছে। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন।
দরাজ কণ্ঠে শাইখের বলা প্রতিটি শব্দ আজো কানে বাজে। স্রষ্টার সিদ্ধান্তে কী অপূর্ব নিবেদন! সেদিন পুরোপুরি সুস্থ লাগল তাঁকে। অনেকটা শঙ্কামুক্ত হলাম। পরের দিন তাঁকে বাসায় আনা হয়। এরপরও বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ছিলেন। এভাবেই কেটে গেলো সেই বছর।
এ রমজানেই আমরা তাঁকে হারাই। চলে আসি জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া ঢাকায়। এখানকার সকল শাইখই ছিলেন কাজী সাহেব (রহ.)-এর চেতনায় চির উজ্জীবিত। বোস্তানে মুতাসিমের একেকটি ফুল। চারদেয়ালের ভেতর শুধু একই ফুলের সৌরভ। দেয়াল চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ছে সেই একই চেতনা, একই সুর। নিকেতনের পাশে সেদিনের ছোট্ট সেই বৃক্ষটি পত্রপল্লব ছড়িয়ে আজ দেশজুড়ে দেওবন্দিয়াতের সুবাতাস ছড়াচ্ছে। প্রত্যেকেই যুগের কিংবদন্তি। সেবছরের সমাপনী অনুষ্ঠানের দিন ঘনিয়ে এলো। শাপলা চত্বরের দ্বিতীয় বছর। সিলেটের হেফাজত আমির আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী সাহেব (রহ.) ও ঢাকা মহানগরীর আমির আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী সাহেব (রহ.) ছিলেন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত মেহমান। আরেকজনও ছিলেন। কাজী সাহেব যাকে ‘উস্তাদতুল্য শাগরিদ’ হিসেবে সম্বোধন করতেন।
কাজী সাহেব (রহ.)-এর পছন্দে যে কারো আবেগ কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক
শাপলা চত্বরের বছর আমি ছিলাম মালিবাগ জামেয়ায়। এখানে খতমে বোখারী শানদার করে উদযাপিত হয়। কাজী সাহেব হুজুর (রহ.)-এর জীবনের শেষ অনুষ্ঠান। প্রতি বছর বিদেশি মেহমান আসেন। সে বছর দেশের পরিস্থিতি নাজুক থাকায় বাহিরের কেউ আসেননি। কাজী সাহেব (রহ.)-এর নির্দেশেই হবিগঞ্জী সাহেবকে দাওয়াত করা হয়। এবারই প্রথম নামটি শুনলাম। কাজী সাহেব (রহ.)-এর পছন্দে যে কারো আবেগ কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক। দেশে চলছিল বিএনপি-জামায়াতের একচেটিয়া জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন। টানটান উত্তেজনা সর্বত্র বিরাজমান। চা-দোকান থেকে নিয়ে সর্বত্রই তুমুল আলোচনা ও সমালোচনা। কওমিপাড়া তো এক ধাপ এগিয়ে। মওদুদিদের সাথে তাল মিলিয়ে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে যত ইচ্ছে তুলোধুনো করছি কাজী সাহেবের সেই উস্তাদতুল্য শাগরিদকে।
সেদিন হবিগঞ্জী সাহেব বয়ানে উলামায়ে সু বলায় মুহূর্তের ভেতর মূহুর্মূহু শব্দে মসজিদ কেঁপে ওঠে। শ্লোগানের পর শ্লোগানে মুখরিত ছিল সেই মজলিস। কথায় কথায় অনেকের সন্দেহের তীর এক দিকেই। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
পরবর্তী বছর জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়ার সমাপনী অনুষ্ঠানে হাবিগঞ্জী সাহেবকে দ্বিতীয়বারের মত পেলাম। আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী সাহেব (রহ.) মাঝপথ থেকে ফিরে যান। সেই উস্তাদতুল্য শাগরিদের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল দিন কয়েক আগে। এ অসুস্থতা নিয়ে নিজ হাতেগড়া ছাত্রদের আবদার ফেলেননি কোনোমতেই। তাঁর সাথে হবিগঞ্জী সাহেবকে এক মজলিসে দেখাও ছিল সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। হেফাজত ইস্যুতে দুইজন দুই মেরুর। হার্ট সার্জারি হয়েছিল দিল্লিতে। হযরত মাওলানা সাইয়্যিদ মাহমুদ আসআদ মাদানীর তত্ত্বাবধানে। এ মজলুম আলেমের বিরুদ্ধে কতটা তথ্যবিভ্রাট ছড়ানো হয়, একটি ঘটনা থেকে সহজেই অনুমিত হবে।
একবার মাওলানা আবু সুফিয়ান যাকি সাহেবের কাছে গেলাম। এক তরুণ আলেমের সাথে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। অনেক বড় মাপের লেখক, ভালো মুহাদ্দিস। তাঁর বাবা আরজাবাদ মাদরাসার বহুত বড় মুহাদ্দিস। এসব বলার পর আলেম সাহেব একটু নড়েচড়ে বসেন। নতুন পরিচয় পেয়ে আবারো মুসাফাহা করে নিই। মাওলানা সাহেব এখন কিছুটা ভাবে আছেন। লম্বা এক বয়ান শুনালেন। মিতব্যয়ী হওয়ার সবক নাকি কাজী সাহেব (রহ.)-এর সেই উস্তাদতুল্য শাগরিদের কাছ থেকে আলেমদের নেওয়া উচিত। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। তাই যথেষ্ট অর্থসম্পদের মালিক হওয়ার পরেও নিজেকে টেনে ধরার মাদ্দা অর্জন করতে হবে আলেমদের। হাজারো কোটি টাকা তাঁর একাউন্টে থাকার পরও তিনি খুবই মিতব্যয়ী। মাওলানা সাহেব সাবলীল ভাষায় কনফিডেন্স নিয়ে এসব বলায় সত্যিই আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। সেদিন মনে হল, আসলেই মানুষ থেকে শয়তানেরও অনেক কিছু শেখার আছে।
অথচ হার্টের রোগে অনেক দিন ভুগছিলেন এ মজলুম আলেম। পর্যাপ্ত অর্থকড়ি না থাকায় উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না। বুকের যন্ত্রণায় রাতে বিছানায় এপাশওপাশ করেছেন। আওলাদে রাসূল, হযরত মাওলানা সাইয়্যিদ মাহমুদ আসআদ মাদানী বারবার তাগাদা দিচ্ছেন ইন্ডিয়ায় যেতে। পর্যাপ্ত অর্থকড়ি না থাকায় সাহসে কুলাচ্ছিল না। অনেক পীড়াপীড়ির পর নিজের যৎসামান্য যা ছিল তা নিয়ে গেলেন। যাওয়ার পর দেখলেন, হযরতের পক্ষ থেকেই সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। লিল্লাহিল হামদ।
উস্তাযের প্রতি কতটা নির্মোহ ভালোবাসা ও ভক্তিশ্রদ্ধা থাকলে এ পাথুরে মানুষটাও হুঁহুঁ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন!
সমাপনী অনুষ্ঠানে মাওলানা আব্দুল গাফফার সাহেব কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিলেন, আমাদের ব্যক্তিত্ব গঠনে তিন দিকপালের অবদান অনস্বীকার্য। দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়াত এদের কাছ থেকেই শিখেছি। এক দিকপালকে হারাই গত বছর। দু’জন জীবিত এখনো। অনিবার্য কারণে একজন আসতে পারেননি। তোমাদের সামনে অন্যজন উপবিষ্ট। একথা বলতে বলতে তাঁর কথা জড়িয়ে যায়। মুহূর্তেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। দূর থেকে মাওলানা আবদুল গাফ্ফার সাহেবকে দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে যায়। গুরুগম্ভীর ও রাশভারী মানুষ। উস্তাযের প্রতি কতটা নির্মোহ ভালোবাসা ও ভক্তিশ্রদ্ধা থাকলে এ পাথুরে মানুষটাও হুঁহুঁ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন! দেওবন্দিয়াত ও মাদানিয়্যাত জীবনভর লালন করে আসছেন। ক্লাসে একবার দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগের আলোচনা আসলে হযরতকে দেখি আগ্নেয়গীরির মত ফেটে পড়তে। হযরতের দীর্ঘদিনের পুরনো ক্ষোভ যেন বিস্ফোরিত হচ্ছিলো। মূলত তা ছিল মুসলিম লীগের প্রতি তাঁর চরম ক্ষোভ ও দ্রোহের বহিঃপ্রকাশ।
সেই দিকপালের সরাসরি বক্তব্য সেদিন প্রথম শুনলাম। হবিগঞ্জী সাহেব বয়ানের মাঝেই বলে উঠলেন, এ মাওলানাকে বাঙালি আলেমরা চিনল না। অফিসকক্ষে দুই বয়োবৃদ্ধের খুনসুটিও ছিল চোখে পড়ার মত। মাদ্রাসার অফিসে এ দিকপাল রসিকতার ছলে হবিগঞ্জী সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি দেওবন্দের সন্তান হয়ে কী হক পালন করছেন? হবিগঞ্জী সাহেব বললেন, আপনি আমাকে আগে এ প্রশ্ন করুন যে, আমি এই মাওলানা সাহেবের কী হক আদায় করছি? এ বাংলার আল্লামার প্রতি হবিগঞ্জী সাহেবের শ্রদ্ধা ও আস্থা কতটা প্রগাঢ় ও সুগভীর সেদিন নিজ চোখে দেখলাম। মালিবাগ জামিয়ার ঐ দিনের বক্তব্যে উলামায়ে সু কাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, তা না বুঝেই কেন যে মসজিদ চত্বরে লাফানো হলো, আজও এর কারণ খুঁজে পেলাম না। নাকি না বুঝেই নাচা এদের স্বভাব?
কাজী সাহেব হুজুর (রহ.) চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেলেন তাঁর আদর্শের এক ঝাঁক উত্তরসূরী। আদর্শের প্রশ্নে যারা অনড় ও অবিচল। হাজারো সাইক্লোন এদের উপর দিয়ে বয়ে যায় কিন্তু বিন্দুমাত্রও টলাতে পারে না যাদের। বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়। ইসলামের নামে যত সহিংসতা ও তাণ্ডবলীলা ঘটেছে, এঁদের কেউ এসবে নেতৃত্ব দেওয়া তো দূরের কথা, সমর্থন জানিয়েছেন এমন কোনো নজীর নেই।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা দ্বীনের মেহনত, দাওয়াত ও তাবলীগে হাঙ্গামা লাগিয়ে একদল নিজেদের স্বার্থ লুটে নেয়। কিন্তু তখনও তাঁদের ভূমিকা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলার সুযোগ পায়নি।
মাওলানা সাদ সাহেবের বিষরটি মাঠে গড়ানোর আগেই আমরা প্রথম জেনেছি মাওলানা আব্দুল গাফফার সাহেবের কাছে। হাদীসের তাকরীর করতে গিয়ে হুজুর বলেছিলেন, মাওলানা তো হাদীসের তাহরীফ করে। তোমরা এবারের ইজতেমায় গেলে তাঁর বয়ান গুরুত্বের সাথে রেকর্ড করবে। দিন দশকের ভেতর সেবারের ইজতেমায় আমরা অংশগ্রহণ করি। যদিও সেবার তাঁর বয়ানের কেউ খুঁত ধরতে পারেনি। আলেম ওলামাদের শান বরঞ্চ তার মুখে ফুলের মত ফুটছিল। সাদ সাহেব সম্পর্কে মতামত ততোটাই মাওলানা আব্দুল গাফফার সাহেবগণ পোষণ করতেন, যতটা তাঁদের দিকপাল পোষণ করতেন। যখন অপরিপক্বরাই জাতির কর্ণধার বনে গেল তখনই এই বিপত্তিটা ঘটে। ইফকের কাহিনীর মতো মুনাফিকদের প্রোপাগান্ডায় মিসতাহ রাদিয়াল্লাহু তায়ালার মত নিরেট সাহাবিগণও যে ভুল বুঝাবুঝির শিকার হননি তা বলছি না। উম্মত-দরদি ও আমিনুন্নাসিহিনদের ছেড়ে কেউ মাসির দরদ দেখাতে গেলে এমনিই হয়। বোর্ডিংয়ের সাদা ডাল সহজেই পেটে যায় কিন্তু ‘দেওবন্দ যা বলে আমিও তাই বলি’-এই প্রাঞ্জল ও সহজোক্তি যায় না কেন? মোটেও বুঝে আসে না।
মাওলানা আব্দুল গাফফার সাহেব, মাওলানা আবুল বাশার সাহেব ও মাওলানা আব্দুল মতিন সাহেবদের মতো মহিরূহদেরকে অন্তত তাবলীগ ইস্যুতে উস্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায় কিনা, এজন্য আদা-জল খেয়ে একদল মাঠে নামে। ইকরার ঝিল মসজিদে আমি আর আমার এক সহপাঠী সাকফি ভাই একবার নফল ইতেকাফে বসি। সেবার শায়েখদের সাথে দেখা করতে তাঁদের মসজিদে যাই। একজন আমাদেরকে একসাথে দেখে বললেন তোমরা নাকি মাওলানা সাহেবের পক্ষে এখনো? কোনো রকম সংকোচ ছাড়াই উত্তর দিলাম। তিনি বললেন, আমিও আগের মতোই হুযুরকে ভালোবাসি। তাঁর উপর পূর্ণ আস্থা রাখি। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি বড়ই নাজুক। এসব বলছেন আর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। তাঁর মুখে শুনলাম একদিন একটা বই নিয়ে মাদ্রাসার অফিসে ঢোকেন মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব। ডেস্কের উপর রেখে মাওলানা আবুল বাশার সাহেব ও মাওলানা আব্দুল গাফফার সাহেবকে সম্বোধন করে বললেন, আপনারা আর কতকাল চুপ থাকবেন? জিহাদের তাহরিফ করা হয়েছে কীভাবে দেখেন।
এভাবেই প্রতিনিয়ত যখন উস্তাদের উপর ভক্তি ও আস্থার দেয়ালে হাতুড়ি মারা হয়, তখন আরো আগেই দেয়াল ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার কথা। কিন্তু পাহাড় তো সহজে টলবার নয়।
সেদিন একজন উস্তাদ এ নিয়ে খুব সুন্দর বলেছেন, ‘তিনি তো লিখে সবাইকে জানিয়েছেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সাথে জিহাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই পিছে পিছে না বলে আব্দুল মালেক সাহেবেরও উচিত লিখে তা প্রমাণ করে দেখানো যে, তিনি কী তাহরীফ করেছেন? আমরা সহজে দেখতে পাবো। অযথা যুক্তিবহির্ভূত কথা বললে তো সুশীল সমাজ নিবে না।’
নীতিনৈতিকতা, আখলাক ও চিন্তার বৈচিত্রে কাজী সাহেব (রহ.)-এর উপমা দিতে গেলে প্রথমে মাওলানা আবুল বাশার সাহেবের কথাই আসবে। তাঁকে যুগের মুজাদ্দিদ বলা হয়। একবার বেফাক পরীক্ষার আর বাকি সপ্তাহ দুয়েক, এর ভেতর দেশের তাপমাত্রা অসহনীয় মাত্রায় বেড়েছিল। ছাত্রদের স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে এক সপ্তাহের জন্য হঠাৎ মাদ্রাসা বন্ধের ঘোষণা দেন। কথা-কাজে দেখিয়েছেন যে, ফলাফলের উপর ছাত্রদের জীবনের সফলতা নির্ভর করে না। ছোট থেকে ছোট প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁর রয়েছে শিল্পের মাধুর্য।
মিছিল মিটিং আন্দোলনে এঁরা বরাবরই থাকেন নিষ্ক্রিয়-নিষ্প্রভ। কিন্তু কেন? মাওলানা আব্দুল গাফফার সাহেব বলেছিলেন, মালিবাগ থাকাকালে আমি দেখতাম আবুল বাশার সাহেবসহ আরো কয়েকজন উস্তাদ ইসলামী খেলাফতের জন্য দিনরাত এক করে দিচ্ছিলেন। আমি জানতাম এর শেষ কী হবে। শুধু অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি। পরে আমার ধারণাই সত্যি হলো। ক্ষমতা ও পদের লড়াই দেখে আবুল বাশার সাহেবের মত মানুষ সরে আসেন এ আবেগ থেকে।
“মাওলানা কাসিম নানুতুবি ও মাওলানা রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহি রহ. বিপ্লবী আলেম ছিলেন। তারা ঘরের ভেতর গর্তে মুখ গুজে থাকা মোল্লা মুনশি ছিলেন না। কিন্তু তারা কেন মাদ্রাসা ও খানকার চার দেওয়ালে আবদ্ধ হলেন? একটি বড় স্বপ্ন নিয়ে। কী ছিল সেই স্বপ্ন?” – পড়ুন মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান রচিত ‘দেওবন্দের সূর্য সন্তান ‘মাওলানা কাজি মুতাসিম বিল্লাহ’
মাওলানা আব্দুল মতিন সাহেব হলেন কাজী সাহেব (রহ.)-এর আরেক প্রতিচ্ছবি। হাদীসে পাণ্ডিত্যের পাশাপাশি তাঁর মতো তাসাওউফে প্রগাঢ় জ্ঞান খুব কম লোকেরই আছে। বোখরীর শেষ দরসগুলোতে আবুল বাশার সাহেব বারবরই তাগিদ দিতেন মাওলানা আব্দুল মতিন সাহেবের কাছে বাইআত নিতে।
তাঁর মতে, ‘এদেশে হক্কানী পীর মেলা সোনার হরিণ মেলার মতই বিরল। মাওলানা আব্দুল মতিন সাহেব অনেক যবরদস্ত ব্যক্তির মুজায। ব্যক্তি জীবনেও আমি তাঁর মত আহলুল্লাহ খুব কমই পেয়েছি।’
একজন সহকর্মীর ব্যাপারে মন খুলে স্বীকৃতি মানুষ কখন দিতে পারে সহজেই তা অনুমেয়। এখানে খুবই লক্ষণীয় যে, কতটা উদার চিন্তার অধিকারী তাঁরা। এমন অসংখ্য কাহিনী রয়েছে যা বলে শেষ করার মত না। এতজন বাঘা বাঘা লোকদের জমায়েত এই মাদ্রাসায় অথচ কখনও দলাদলি ও স্বজনপ্রীতির গন্ধ কেউ খুঁজে পাবে না এখানে। পুঁথি-গাঁথা-বই-পুস্তক পড়ে কখনই সম্ভব নয় এমন আখলাক ও নৈতিক উৎকর্ষ হাসিল করা। বই পড়ে জ্ঞান হাসিল হয় সত্য। চেতনা ও নৈতিক উৎকর্ষ নয়। একজন শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় এটি কেবল সম্ভব।
কাজী সাহেব (রহ.)-এর ছাত্রদের মাঝে একজনকে পুরোপুরি ‘কাজী সাহেব’ বললে মোটেও বেশি বলা হবে না। শাইখুল ইসলাম যেভাবে নিজেকে শাইখুল হিন্দের রঙে রাঙিয়েছেন, রাহিমাহুমাল্লাহ, কাজী সাহেবের রঙেও সেই একজন নিজেকে পুরোপুরি সাজিয়েছেন। যশোরে কাজী সাহেব (রহ.)-কে নিয়ে এক স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। সেখানে একটি বই উন্মোচন করেন সভার আয়োজক বাড্ডার মাওলানা আব্দুল মজিদ সাহেব। তাঁর দাবি মতে, কাজী সাহেব হুজুরের হুবহু পদাঙ্ক অনুসরণ করেন বাংলাদেশের কেবল এই একজনই। যিনি কাজী সাহেব (রহ.)-এর জানাযার সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আজ আমার যা কিছু, সবই তাঁর অবদান।’ হ্যাঁ, যাকে জীবদ্দশায়ও কাজী সাহেব (রহ.) নিজের প্রত্যেকটি কাজে পরামর্শক জ্ঞান করতেন। ঘর ও বাহিরের সর্ব বিষয়েই কাজী সাহেবের একমাত্র ভরসা ছিলেন যিনি। আলকাউসারে একবার কাজী সাহেব (রহ.)-এর সহধর্মিণীর একটা সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। একমাত্র আদরের কন্যার লেখাপড়া নিয়ে কাজী সাহেব ছিলেন চরম উদ্বিগ্ন। উস্তাদতুল্য শাগরিদের পরামর্শক্রমেই কোন আবাসিক মহিলা মাদ্রাসায় না পড়িয়ে বাসায় রেখে পড়ান। এই সাক্ষাৎকারে ছাত্র হিসেবে একমাত্র তাঁর নামই কাজী সাহেব (রহ.)-এর সহধর্মিনীর মুখে উচ্চারিত হয়।
এ উস্তাদতুল্য শাগরিদকে নিয়ে বিশাল কলবরে শখ মিটিয়ে লেখার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কাজী সাহেবের ভাষায় ‘পিদিম হয়ে সূর্যের প্রশংসা করে সূর্যকে খাটো করার কোনো মানে নেই।’
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে।।”
“আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী, –
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি।”
– এদুটো কবিতা আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রহ.)-এর মুখে প্রায়শই শুনতে পেতাম। আজ এ দুটো কবিতাকে পাই ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ হিসেবে।
ফিদাহু আবী ওয়া উম্মী।
লেখক: শিক্ষক ও তরুণ আলেম