- আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ
দু’রাকাত নামাযের মধ্যে সৃষ্টির ইবাদতের সারনির্যাস বিদ্যমান
পৃথিবীর সব কিছুই স্ব-স্ব অবস্থায় আল্লাহর ইবাদতে মশগুল। কেউবা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কেয়াম ও দাঁড়ানো অবস্থায় সে নিয়ত আল্লাহর তাসবীহ পড়ে যাচ্ছে। কোনো বস্তু নতজানু হয়ে আছে। এই নতজানু অবস্থায় সে আল্লাহর তাসবীহ ও তাহলীলে মশগুল। কোনোটা আবার পেটে ভর দিয়ে মাথানত করে সেজদা অবস্থায় আছে। প্রকৃতির কোনো কিছুই আল্লাহর তাসবীহের বাইরে নেই। তাঁর ইবাদতের বাইরে নেই। কুরআন মাজীদে আল্লাহ জাল্লা জালালুহু ইরশাদ করেন-
وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَظِلَاهُمْ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ
আর আল্লাহর জন্যই সেজদাবনত চার ও নাচার আকাশমণ্ডলী ও জমিনের সবকিছু আর এর ছায়াসমূহ সকাল সন্ধা সিজদায় অবনত। [সুরা আর রাদ, আয়াত: ১৫]
চন্দ্র সূর্য তারা নক্ষত্র আর বৃক্ষলতা সবাই সেজদাবনত সেই মহান সত্ত্বার উদ্দেশ্যে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ بِحُسْبَانٍ وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدَانِ
সূর্য আর চন্দ্র তারাও তো হিসাবমত চলছে। নক্ষত্র ও বৃক্ষলতাও তো সেজদায় অবনত। [সূরা আর রাহমান, আয়াত : ৬]
শুধু কি তাই? আসমান জমিনের সবকিছুই শামস কামার ও নক্ষত্রমণ্ডলী, পর্বতমালা, বৃক্ষরাজি ও বিচরণরত পশু সবাই তো স্ব অবস্থানে একই মহাপ্রভূর সামনে ইবাদতরত । আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন-
ألم ترأَنَّ اللَّهَ يَسْجُدُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ وَالنُّجُومُ وَالجِبَالُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ وَكَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ
দেখছ না? নিশ্চয়ই আল্লাহর তরে সেজদারত যা আছে আকাশে আর যা আছে জমিনে, সূর্য চন্দ্র আর তারকাপুঞ্জ পর্বত আর বৃক্ষরাজি এবং ভূমিতে বিচরণরত পশু এবং মানুষেরও বহুজন। [সূরা হজ, আয়াত: ১৮]
সবকিছুই তাঁর নামায় ও তাসবীহ সম্পর্কে অবহিত। ইরশাদ হচ্ছে-
ألم تر أنَّ اللهَ يُسَبِّحُ لَهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالطَّيْرُ صَافَّاتٍ كُلُّ قَدْ عَلِمَ صَلَاتَهُ وَتَسْبِيحَهُ ، وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِمَا يَفْعَلُونَ
লক্ষ করেছ, আল্লাহর তরে সবাই তো তাসবীহরত— যা আছে আকাশে আর জমিনে, পাখা বিস্তারকারী পক্ষীকুলও, এদের প্রত্যেকেই জানে নিজ নিজ নামায ও তাসবীহ।
আল্লাহ তো খুব অবহিত এরা যা করছে তা। [সুরা আন নূর, আয়াত : ৪১]
তবে সেই তাসবীহ ও তাহলীলে এবং তাদের ইবাদত সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আমাদের নেই, ইরশাদ হচ্ছে-
وَإِنَّ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّح بِحَمْدِهِ وَلَكِنْ لَا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ
এমন কিছুই নেই যে তাঁর হামদসহ তাসবীহ পাঠ করে না; তবে তোমরা বুঝ না তাদের তাসবীহ [সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত : ৪৪]
নূর ও জ্যোতির্ময় ফিরিশতারাও বিভিন্ন ভঙ্গিতে সারক্ষণ আল্লাহর ইবাদত ও তাসবীতে মাশগুল। এক লহমার জন্য তো তাঁরা থাকেন না গাফেল। ইবাদত ও তাসবীহ কীর্তনে তাদের ক্ষান্তি নেই, ক্লান্তিও কখনো পায় না তাদের।
কুরআন মাজিদে ইরশাদ হচ্ছে-
وَلَهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَنْ عِندَهُ لَا يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِهِ وَلَا يَسْتَحْسِرُونَ يُسَبِّحُونَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لَا يَفْتُرُونَ
আর তাঁরই জন্য তো আকাশমণ্ডলী ও জমিনে যা কিছু আছে সব। আর যারা আছে তাঁর সান্নিধ্যে তারা তো অহংকার প্রদর্শন করে না তাঁর ইবাদত বন্দেগিতে । ক্লান্তিবোধ করে না। তাঁর তাসবীহ পাঠ করে রাত-দিন, বিরতিহীন। [সুরা আল আম্বিয়া, আয়াত : ১৯-২০]
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ যখন নামায আদায় করে তখন সমস্ত সৃষ্টির ইবাদত শামিল হয়ে যায় তাঁর সাথে । মানুষের সালাতে কেয়াম, রুকু, সিজদাহ, তাসবীহ, যিকির, কুউদ বৈঠক সবই বিদ্যমান। সুতরাং ইখলাসের সাথে বান্দা যখন নামায আদায় করে সমস্ত সৃষ্টি যে যেই ভঙ্গিতেই করুক না কেন সকলের সওয়াব একত্রে সে পায়। এই মহিমান্বিতা এই ফজিলত আর কোথাও নেই।
মুমিনের মেরাজ
আল্লাহতায়ালা তো নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজে দাওয়াত দিয়ে মেরাজ রজনীতে সওগাত হিসেবে এই উম্মাতকে সালাত বা নামায উপহার দেন । এই নামায তো মুমিনেরও মেরাজ। প্রতিদিন যেন পাঁচবার মেরাজ লাভ করতে পারে সে। মাশুক ও মাহবুব প্রিয়তমের দিদারে ধন্য হয় মুমিন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইবাদত করবে এভাবে যে মাবুদকে তুমি সম্মুক্ষে প্রত্যক্ষ করছ; সেটা সম্ভব নাহলে অন্তত এটা ধ্যান করবে, তিনি তো অবশ্যই তোমাকে প্রত্যক্ষ করছেন।
গুনতিতে পাঁচ সওয়াবে পঞ্চাশ
মূলত নামায তো ছিল পঞ্চাশ ওয়াক্ত। উম্মাতের ওপর রহম করে হযরত মুসা আলাইহিস সালামের ইশারায় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দরবারে বারবার আরজি জানিয়ে পাঁচ পাঁচ করে হ্রাস করতে করতে শেষে পাঁচে এসে স্থির হয় তা। আল্লাহ পাক তাঁর মহান মহিমায় ঘোষণা করলেন, গুনতিতে হবে পাঁচ ওয়াক্ত, কিন্তু সওয়াব হবে পঞ্চাশের।
মানবজীবনে নামাজের গুরুত্ব গ্রন্থ থেকে চয়ীত (অপ্রকাশিত)