তাড়াইল ইজতেমা: আখেরি মোনাজাতের আগের রাতের চিত্র

তাড়াইল ইজতেমা: আখেরি মোনাজাতের আগের রাতের চিত্র

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : রাতের ঝাপটা বাতাস আর ফোঁটায় ফোঁটায় পড়া শিশিরে জেঁকে বসেছে শীত কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে। রাস্তাঘাট ফাঁকা। নেমে এসেছে নীরবতা। কিন্তু এর মাঝে ব্যতিক্রম বেলঙ্কার ‘জামিয়াতুল ইসলাহ’ ময়দান। এখানে বিশাল ইজতেমা মাঠে তখনো হাজারো মুসল্লির ব্যস্ততা। কেউ ব্যস্ত রান্নায়, কেউ গোসলে, কেউবা ব্যস্ত ইবাদতে। জেঁকে বসা শীত বা রাতের নিস্তব্ধতা—কোনো কিছুর আঁচড় নেই এখানে।

গতকাল শনিবার দিবাগত রাত ২টায় শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ-এর আহ্বানে আয়োজিত কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের বেলঙ্কার ইসলাহী ইজতেমার মাঠে গিয়ে দেখা গেছে এমন চিত্র। আজ রোববার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হচ্ছে এবারের ইসলাহী ইজতেমা।

রাত ২টা ৪০ মিনিটে ইজতেমা মাঠের হাঁটাপথ ধরে এগিয়ে দেখা গেলো, দুপাশে বিশাল শামিয়ানার নিচে মানুষ আর মানুষ। অনেকে তখন কাঁথা-কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ মৃদুস্বরে কান্নার শব্দ ভেসে এলো কানে। ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি মোনাজাত করছেন। জাগতিক জীবনের সব পাপ থেকে মুক্তিলাভের আশায় মহান আল্লাহর কাছে করছিলেন কান্নার মাধ্যমে অনুনয়-বিনয়। মৃদু শব্দে সেই আর্তিই ভেসে আসছিল কানে।

প্রায় ১৫ মিনিট পর মোনাজাত শেষ হলো। কথা বলে জানা গেলো, তাঁর নাম হোসাইন আলী। এসেছেন রংপুর থেকে। তিনি বলছিলেন, ‘আবার এক বছর পর ইজতেমা হবে। এর মাঝে বাঁচি কি মরি, তার ঠিক নাই। এ জন্যই আজ রাতে মহান আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করছিলাম। তাছাড়া, রাতে পরিবেশ খুব নিরিবিলি থাকে। সবাই ঘুমায়। তখন আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করলেও মনে শান্তি লাগে। মনে হয় আল্লাহ খুব কাছে থেকে আমার কথাগুলো শুনছেন।’

ইজতেমার মাঠের পাশেই বিশাল পুকুর। ইজতেমায় আগত মুসল্লিরা এখানে গোসল, অজুসহ রান্নাবান্নার পানি সংগ্রহ করেন। পুকুরের কাছে রাত ৩টার সময় অনেক মুসল্লির ভিড় দেখা গেলো। তাঁদের কেউ গোসল করছেন, কেউ অজু করছেন, কেউবা নিচ্ছেন রান্নাবান্নার পানি।

কথা হয় ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে আসা আসগর আহমদের সঙ্গে। তিনি রান্নার জন্য পানি নিতে এসেছেন। আসগর বললেন, ‘আখেরি মোনাজাতকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই প্রচুর মানুষের ভিড় বাড়বে। হাঁটাচলার জায়গা থাকবে না। তখন রান্না করাও কঠিন হবে। তাই সকালের রান্না এখনই করে ফেলছি।’

পুরো ইজতেমা মাঠ জুড়ে ছোট ছোট গলি বা হাঁটাপথের মাধ্যমে চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি পথেই তখনো অসংখ্য মুসল্লির চলাচল। কেউ ঘুম থেকে উঠে অজুর জন্য বের হয়েছেন, কেউ শৌচাগার ব্যবহারের জন্য, আবার কেউবা হাঁটছিলেন অন্যান্য আনুষাঙ্গিক কাজে। এত সবকিছুর মাঝেও সবার হাঁটাচলায় ছিল শৃঙ্খলা। সবাই নিজের মতো করে যার যার কাজে যাচ্ছিলেন। এর বাইরে ছোট ছোট জটলা দেখা গেল জিকির ও ধর্মীয় আলোচনায় ব্যস্ত।

পুরো মাঠেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সরব উপস্থিতি। মুসল্লিদের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিকই হাঁটাচলা করছিলেন এদিক-সেদিক। কিন্তু এর বাইরেও চোখে পড়ল ইজতেমার মুসল্লিদের নিজস্ব পাহারাব্যবস্থা। প্রায় প্রতিটি রাস্তা, গলিপথ বা প্রবেশমুখের সামনে হাতে বাঁশের লাঠি নিয়ে অবস্থান করছিলেন তাঁরা। অপরিচিত কেউ এলে বা কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে তাৎক্ষণিক এগিয়ে আসতে দেখা যায় তাঁদের। তীব্র শীত বা ঠাণ্ডা বাতাসের প্রকোপ থাকলেও তাঁরা দায়িত্ব পালনে ছিলেন অবিচল।

মাঠে ঘুরতে ঘুরতেই হঠাৎ মাইক বেজে উঠল। তখন সময় ভোররাত প্রায় পৌনে চারটা। একজন মাইকে ঘোষণা দিলেন তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় ও কিছু আমলের। সঙ্গে সঙ্গে বিস্তর পরিবর্তন লক্ষ করা গেল পুরো মাঠে। মুসল্লিরা এক এক করে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতে ঘুম থেকে উঠতে শুরু করলেন। তাঁদের পদচারণে আবারও গমগম করতে লাগল তাড়াইল ইজতেমা মাঠ।

আল্লাহ তাআলা এই ইসলাহী ইজতেমার আয়োজক ও আগত সকল মুসল্লিকে কবুল করুন। তাদের মনোবাসনা পূরণ করুন। সেই সাথে এই উম্মাহকে আজীবন সিরাতে মুস্তাকিমের উপর চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *