- আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ
পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে আজ বেশ অনেকগুলি মুসলিম দেশ নজরে পড়ে। সংখ্যার দিকে তাকালে গর্বে ভরে উঠে বুক, আশ্বস্ত হয় মন। একদিন যে আলোর উন্মেষ হেরার ছোট্ট গুহায়, ফারানের চূড়া বেয়ে, বুতহা, মীনা আরাফার দিগন্ত পেরিয়ে, বদর উহুদ-খন্দকের উপত্যাকা হয়ে আজি তা বিস্তৃত সাগর মহা-সাগরের অপর পারেও।
সত্যই ‘জাআল হাক্কু ওয়া যাহাকাল বাতিল’ হক আসে, বাতিল হয়ে যায় বিলীন। তাওহীদী কণ্ঠের লাখো উচ্চারণে প্রকম্পিত দশ দিক- সবই সত্য । কিন্তু, হ্যাঁ কিন্তুই একটি প্রশ্ন জাগে মনের নিভৃতে। যে কতিপয় ক্লিষ্ট অথচ আলোয় আলোয় তেজঃদীপ্ত কতিপয় মহাপ্রাণ সচকিত আওয়াজে দাঁড়িয়ে ছিলেন বদরের প্রান্তে, কর্মীর হাতিয়ার নিয়ে নেমে পড়েছিলেন খন্দকের মাঝে, প্রবল প্রচণ্ড তাপে দহিত হয়েছিলেন তাবুকের বিয়াবানে, তাদের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর নির্যাতিত মানব গোষ্ঠী পেয়েছিল যে আশ্বাস, যাদের দৃষ্টিতে ত্রাসিত হয়ে উঠত শয়তানিয়্যাতের অন্তরাত্মা। সত্য কি আমরা কি বাস্তবেও তাদের উত্তরাধিকারী?
আজ যদি তাদের কেউ আল্লাহর হুকুমে দুনিয়াতে ফিরে আসেন তবে কি আমাদের দেখে চিনতে পারবেন আখেরী নবীর উম্মাতরূপে? মানচিত্রের সবুজ কালি অঙ্কিত দেশগুলি তাওহীদবাদী বলে পরিচয় দানকারী অঞ্চলগুলিকে কোন ক্ষেত্রে, কী হিসাবে হরিদ্রাঙ্কিত বা লোহাতাঙ্কিত রাষ্ট্রগুলি থেকে আলাদা করা সম্ভব আজ?
আবু জেহেল যদি কোনক্রমে আসতে পারে আমাদের এই দুনিয়ায় তবে কি উল্লসিত হয়ে উঠবে না তার চোখ আমাদের দেখে?
সোনালী যুগের একজন মহাপ্রাণ যদি উঠে এসে সফর শুরু করেন এক প্রান্ত থেকে তবে তার সফর অভিজ্ঞতা কী হতে পারে? তাদের সোনালী যিন্দেগীর কোন বৈশিষ্ট্যটি আমাদের মাঝে রং নিয়ে আছে যা দেখে তারা চিহ্নিত করবেন আমাদের? নগ্নতা, অশ্লীলতা, মদ জুয়া কোন দিক থেকে আমরা পিছিয়ে আছি হলুদ ও লাল রং চিহ্নিত দেশগুলি থেকে ?
উচ্চারণ করতেও গা শিউরে উঠে। কোন পূজা উৎসবে যদি সেই মহাপ্রাণ কোন পূজা মণ্ডপের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করে যান তবে লজ্জায় হেট হয়ে যাবে না কি তার মাথা তাওহীদবাদী বলে কথিত উম্মার সন্তানদের বেদীর সামনে জোড় হাত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ?
উল্টাভাবে যদি চিন্তা করা যায়, আবু জেহেল যদি কোনক্রমে আসতে পারে আমাদের এই দুনিয়ায় তবে কি উল্লসিত হয়ে উঠবে না তার চোখ আমাদের দেখে?
জাহিলী যুগের কোন রীতিটি আছে পরোক্ষ বা প্রচ্ছন্নভাবে হলেও জীবন্ত করছি না ফের আমাদের সমাজে? যে ইয়াহুদী নাসারারা কোন ফন্দী বাকি রাখেনি আমাদের ধ্বংসের আজ তাদেরই অনুকরণ করতে গর্ববোধ করে আখেরী নবীর উম্মতের সন্তানরা। মূর্তি পূজারী সংস্কৃতি অনুকরণে আনন্দিত হয় মায়েরা-মেয়েরা। আবু জেহেল সব দেখে আনন্দিত চিৎকার করে উঠবে নিশ্চয়ই— ‘বদরের বদলা নিলাম এবার’।
ভরসা কেবল মুখের দাবীর। তথাস্ত, কিন্তু এটিকে কি বিস্তৃত করতে পারি না হাত-পা-মুখ সর্ব অবয়বে, অন্তরের গহীনে জ্বলে উঠতে পারি না কি ঠিক সেইভাবে যেভাবে জ্বলে উঠেছিলেন একদিন তারা, যারা ছিলেন জাহিলিয়াত যুগের সন্তান, কিন্তু নিজেরা প্রদীপ্ত করেছিলেন পৃথিবীর সব যুগ-সব কাল। দরকার আজ সেই মেহনতের, সেই প্রয়াসের। চিন্তা নেই, পায়ের আওয়াজ বুঝি পাওয়া যায়, আমরাও প্রস্তুত!
সম্পাদকীয়, মাসিক পাথেয়, নভেম্বর ১৯৮৮