ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা সৃষ্টির পেছনে || পর্ব-৩ (সমাপ্ত)

ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা সৃষ্টির পেছনে || পর্ব-৩ (সমাপ্ত)

  • আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

গত পর্বের পর

এখানেই ইংরেজরা ক্ষান্ত করেনি। মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী দেখাতে যেয়ে একদিকে হিন্দুদের বলতে থাকে, “তোমাদের সঙ্গে মুসলমানদের কখনো মিল হতে পারে না, অন্যদিকে মুসলমানদেরকে এদের বিরুদ্ধে উসকাতে থাকে। এক সময় তাদের সামাজিক আচরণ উল্লেখ করে কুম্ভীরাশ্রুও বর্ষণ করে। স্যার হ্যানরী লয়েট হিন্দুদের প্রতি দরদ দেখাতে যেয়ে একস্থানে লিখেন, “হিন্দু লোকদের উপর দুঃখ হয়। অন্তত হিন্দুদের থেকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার সম্পর্কে জানা যেতে পারে যাদের উপর আমরা আশা করতাম। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তারাও মুসলমানদের মত মুহররমকে লেখে মুহররম, কুরআনকে লেখে কালামে পাক এবং লিখার আগে ‘বিসমিল্লাহ্’ লেখে শুরু করে।” -তোফায়েল আহমদ: রওশন মুস্তাকবিল। এতে সাম্প্রদায়িকতাকে কতটুকু উসকে দেয়া হয় তা কারো কাছে অস্পষ্ট নয়।

 শুধু প্রশাসনিক বোঝা কমানোর জন্য বঙ্গভঙ্গ করা হচ্ছে না, বরং নতুন একটি ইসলামী প্রদেশ গড়ে তোলাও এর উদ্দেশ্য। যাতে মুসলমানদের প্রাধান্য থাকবে

অনেক সময় রাজনৈতিক জটিলতার সৃষ্টি করেও সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি দেয়া হত। সেকালে অধিকতর রাজনৈতিক চেতনার অধিকারী বাঙ্গালীদেরকে দ্বিধাবিভক্ত করে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য লর্ড কার্জনের সময় বঙ্গভঙ্গ করা হয়েছিল। কিন্তু একে সাম্প্রদায়িকরূপে চিত্রিত করা হয়। লর্ড কার্জন ঐ সময় ঢকায় এক সভায় বলেছিলেন, “শুধু প্রশাসনিক বোঝা কমানোর জন্য বঙ্গভঙ্গ করা হচ্ছে না, বরং নতুন একটি ইসলামী প্রদেশ গড়ে তোলাও এর উদ্দেশ্য। যাতে মুসলমানদের প্রাধান্য থাকবে।” -মুহাম্মদ মিয়া : উলামা-ই-হক।

এতে যেন ঘিয়ে আগুন ঢেলে দেয়া হল। মুসলমানগণ ইংরেজদের ভাওতায় আশান্বিত হয়ে পড়ে এবং হিন্দুদের বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে অত্যন্ত সন্দেহের চোখে দেখে। ফলে ঐ আন্দোলন সাধারণভাবে হিন্দুদের আন্দোলনরূপে পরিগণিত হয়ে যায়।

ইংরেজরা তাদের এই উদ্দেশ্যের পেছনে যে কোন জঘণ্যতায় নেমে আসতে দ্বিধা করত না। কৌশলে এরা গরু জবাইর বিষয়টি জটিল করে তোলে, যা সাধারণভাবে হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক আবেগে অত্যন্ত আঘাত দেয়। আলীগড় ইউনিভার্সিটির সাবেক ইংরেজ প্রিন্সিপাল মি. ব্যাক ১৮৭০ সালে “ভারতে আধুনিক নির্বাচন প্রচলন ঠিক নয়, কারণ এখানে পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন জাতি বাস করে” এই শিরোনামে বিশ হাজার সাতশ’ পঁয়ত্রিশটি দস্তখত সম্বলিত একটি স্মারকলিপি ইংলেন্ড পার্লামেন্টে  প্রেরণ করেন। কিন্তু এতে দস্তখত নিতে যে জঘণ্য শঠতার আশ্রয় নেয়া হয়, তা ছিল সত্যি অবিশ্বাস্য। তিনি নিজে শিল্পী আমে মসজিদে গমন করেন এবং গরু কুরবানী বন্ধে হিন্দুদের চেষ্টার প্রতিবাদ করা হচ্ছে বলে এতে মুসলমানদের দস্তখত নেন।

অন্য এক সভায় তিনি বলেছিলেন, “কয়েক বছর ধরে ভারতে দু’টি আন্দোলন বড় জোরেসোরে চলছে একটি ন্যাশনাল কংগ্রেসের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন আর অপরটি হচ্ছে গরু কুরবানী বন্ধের আন্দোলন। দ্বিতীয়টি নিঃসন্দেহে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। তাই ইংরেজ আর মুসলমান মিলে হিন্দুদের বিরুদ্ধে লড়া উচিত।” -মুহাম্মদ মিয়া উলামা-ই-হক।

এ মনোভাবের ভিত্তিতেই মুসরিম লীগ ও হিন্দু মহাসড়া এ ধরনের চরম সাম্প্রদায়িক সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এই উভয় ধরনের সংগঠনের পেছনেই ইংরেজদের সহযোগিতা অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। আর এই জন্যই পৃথক নির্বাচনের সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রথা চালু করা হয়।

ভারতের তৎকালীন হক্কানী উলামায়ে কেরাম বরাবরই এই সাম্প্রদায়িক আন্দোলন সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। হযরত শায়খুল হিন্দ রহ. থেকে নিয়ে হযরত মাদানী (রহ.) ও মাওলানা আযাদ পর্যন্ত প্রায় সকল হক্কানী আলেমই অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অগ্রসেনার ভূমিকা নেন কিন্তু তত দিনে ইংরেজদের সুপরিকল্পিত চক্রান্তে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ মহীরুহে পরিণত হয়ে পড়ে এবং ভারত উপমহাদেশব্যাপী সাম্প্রদায়িকতার চরম এক বিষাক্ত হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে। স্থানে স্থানে গরু জবাই ও মসজিদ অবমাননা নিয়ে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। যে ভারতবাসীরা সুদীর্ঘকাল ধরে সকলে সম্প্রতিবেশী হিসাবে রইল, পরাধিনতার পরও প্রায় শতাব্দীকাল একই পতাকাতলে স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মাহুতি দিল এবং মুসলমান ছেলেদের পাশাপাশি অনেক হিন্দু ছেলেও নিজের বুকের তাজা রক্তে নেয়ে উঠেছিল, সেই তারাই উভয়ের শত্রু ইংরেজকে বাদ দিয়ে নিজেরা নিজেরাই খুনাখুনি করে খতম হওয়ার আত্মঘাতী তৎপরতায় মেতে উঠল।

প্রায় দাঙ্গার পেছেনেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের গোপন হস্ত অত্যন্ত সক্রিয় ছিল

১৬ই আগষ্ট ১৯৪৬ সালে লীগের ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে থেকে কলকাতায় সপ্তাহব্যাপী ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। লাখো টাকার সম্পত্তি বিনষ্ট হওয়া ছাড়াও প্রায় চল্লিশ হাজারের মত লোক এতে নিহত হয়। সঙ্গে সঙ্গে মুজাফ্ফরনগর, বিহার, নোয়াখালী এবং ভারতের অন্যান্য স্থানেও ব্যপকবাবে দাঙ্গা ঘটতে থাকে। ক্রমে ক্রমে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠে। পাঞ্জাব, দিল্লী, মিরাট প্রভৃতি স্থানে মারাত্মক দাঙ্গা সংগঠিত হয়। ভারত নিজের রক্তে ভাসতে থাকে। ১৯৪৭-এর দিকে দাঙ্গার আকার ও সংখ্যা অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। দাঙ্গা যেন এই উপমহাদেশের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

এমন বহু ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে যাদ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, প্রায় দাঙ্গার পেছেনেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের গোপন হস্ত অত্যন্ত সক্রিয় ছিল।

অনেক বৃটিশ উচ্চপদস্ত অফিসার সক্রিয়ভাবে দাঙ্গায় অংশ নেয় এবং এর উস্কানি দেয়। এই দেশবাসীরা শান্তির শ্বাস নিয়ে দিন যাপন করবে এ যেন তারা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। লায়লপুরের তৎকালীন মুসলমান ডেপুটি পুলিশ সুপার বলেছিলেন, “এ জেলা থেকে যদি কর্ণেল কৃষ্ণকে সরিয়ে নেয়া যায়, তবে একজন হিন্দু বা শিখও আর নিহত হবে না।” তেমনিভাবে রাওয়ালপিন্ডির দাঙ্গায় ডেপুটি কমিশনার মি. সি এল কোট্স এবং হোম সেক্রেটারী মি. ম্যাক ডোনাল্ডের হাত অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। পূর্ব পাঞ্জাবের এক বৃটিশ মিলিটারী অফিসার শুধু দাঙ্গায় উস্কানি দেয়ার জন্যই লম্বা এক ট্যুর করেছিলেন। ইটালীর পত্রিকা ‘ইউন্টা’য় লেখা হয়েছিল, “বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের উস্কানিতেই এসব হচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরে সুপরিকল্পিতভাবে বৃটিশ বেনিয়ারা সাম্প্রদায়িকতার যে বিষ বৃক্ষ রোপণ করে, সযত্ন পরিচর্যা করে বড় করে তোলে আজো আমরা এর বিষফল ভোগ করছি; আশ্চর্য! মানসিকতা আমাদের আজো স্বচ্ছ নয়। জানি না, আর কত দিন এর প্রায়শ্চিত্ত আমাদের করতে হবে। গলাবাজি করে লাভ নেই। দরকার আমাদের মানসিক পরিবর্তনের।

(সমাপ্ত)

(ইসলাম, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা গ্রন্থ থেকে চয়িত)

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *