অতি প্রশংসার চিন্তানৈতিক খতিয়ান

অতি প্রশংসার চিন্তানৈতিক খতিয়ান

নুরুল ইসলাম শ্রীপুরী : সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে একজন আলেমের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার অতিরঞ্জন চলছে দেখে আমি বিস্মিত। কোন কোন ক্ষেত্রে তাকে তার অবস্থানের চেয়েও অনেক বেশী উপরে উঠানো হয়ে যাচ্ছে।খ্রিষ্টধর্মের যেমন একক ক্ষমতাশালী পোপ আছে, ইসলামে এমন কিছু নেই।

কিন্তু এই অবস্থা চলতে থাকলে ভয় হয় আমরা কি ইসলামের ঠিকাদারী এক ব্যক্তির হাতে তুলে দিচ্ছি কি না। নিজেদের অযোগ্যতায় আমরা কি পোপতান্ত্রিকতা ডেকে আনছি ইসলামে? তার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত কিছু নুমনা চলুন পড়ে আসি..

“তিনি মুজতাহিদে মুতলাকের কাতারে”
“তিনি ইলমে হাদীসের মুজাদ্দেদ”
“উম্মতের বিচক্ষণ আলেমদের সিদ্ধান্ত হলো আল্লাহ তাকে মুতাকাদ্দিমীনের ইলম দান করেছেন”

“তার কিতাব মুতালায়ার গভীরতা ও প্রশস্ততায় স্বাধীন বাংলার কোন আলেম সারা জীবনে পৌঁছতে পারেনি এবং কোনদিন পৌঁছাতে পারবে বলে মনেও হয় না”
“ইউরোপ আমরিকায় যিনি সমানভাবে বরিত”

“তার ইলমের সুঘ্রাণে মাতোয়ারা হচ্ছেন বিশ্বের প্রায় সব জনপদের মুসলমান”

“তিনি শতাব্দিতে একজন আসেন”

“বাংলাদেশের আলিমদের মাঝে সবচেয়ে বেশী মু’তাদিল তিনি”

ইত্যাকার নানা অতিরঞ্জনমূলক সব আলকাব ও বিশেষণ যুক্ত করা হচ্ছে তাঁর নামের কোলেপিঠে।

একজন আলেম অবশ্যই সম্মান ও শ্রদ্ধাভাজনেষু। কিন্তু যদি তার অতিমাত্রার প্রশংসা করা হয় এটা সীমালঙ্ঘন।

হাদীস শরিফে এধরনের সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে কঠোরভাবে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। উদাহরণত কয়েকটি হাদীস পেশ করছি–

عن أبي موسى الأشعري رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قال: سمع النبي صلى الله عليه وسلم رجلاً يثني على رجل ويطريه في المدحة فقال: «أهلكتم أو قطعتم ظهر الرجل» (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ).
হযরত আবু মুসা আশ’আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একলোককে অপর একজনের গুণকীর্তন ও অতিমাত্রার প্রশংসা করতে শুনলেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘ধ্বংস করে দিলে অথবা পঙ্গু করে দিলে তোমরা লোকটির জীবনকে’। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)

وعن أبي بكرة رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أن رجلاً ذكر عند النبي صلى الله عليه وسلم فأثنى عليه رجل خيراً فقال النبي صلى الله عليه وسلم: «ويحك! قطعت عنق صاحبك..» -يقوله مراراً- .. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ).
আবু বাকরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সা. এর সামনে একলোকের ব্যাপারে আলোচনা চলছিলো, আরেকলোক তার প্রশংসা করে উঠলো, ফলে রাসূল সা. বললেন,’ ছিঃ, তুমি তো তোমার বন্ধুর ঘার মটকে দিলে’ বারংবার তিনি একই কথা বলতেছিলেন.. (মুত্তাফাকুন আলাইহি)

وعن همّام بن الحارث عن المقداد رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: “أن رجلاً جعل يمدح عثمان رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فعمِد المقداد فجثا على ركبتيه فجعل يحثو في وجهه الحصباء، فقال له عثمان: ما شأنك فقال: إن رَسُول اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قال: «إذا رأيتم المداحين فاحثوا في وجوههم التراب»” (رَوَاهُ مُسْلِمٌ).
হাম্মাম ইবনে হারিস হযরত মিকদাদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেন একলোক হযরত উসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর প্রশংসা করছিলেন, মিকদাদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হাঁটুগেড়ে বসলেন, এবং সেই লোকের চেহারায় মাটি ছুড়ে দিলেন, উছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, কী হলো তোমার? তিনি বললেন, রাসূল সা বলেছেন, যখন গুণকীর্তনকারীদের দেখো তাদের চেহারায় মাটি ছুড়ে দাও।(মুসলিম শরিফ)

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ ” ، مُتَفَقٌّ عَلَى صِحَّتِهِ.
ইবনে আব্বাস ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, খৃস্টান যেমন মারয়াম তনয় ঈসার মাত্রাতীত প্রশংসা করেছেন তেমন প্রশংসা তোমরা আমার করো না, আমি তো কেবল আল্লাহর বান্দা ও রাসূল ‘। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)

وعن أنس رضي الله عنه، أن ناساً قالوا: يا رسول الله: يا خيرنا وابن خيرنا، وسيدنا وابن سيدنا، فقال: “يا أيها الناس، قولوا بقولكم، أو بعض قولكم، ولا يستهوينكم الشيطان، أنا محمد، عبد الله ورسوله، ما أحب أن ترفعوني فوق منزلتي التي أنزلني الله عز وجل”. رواه النسائي بسند جيد.
হযরত আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, কিছু লোক বল্লো, হে রাসূল্লাল্লাহ, হে আমাদের উত্তমজন, হে উত্তমজনের পুত্র, হে আমাদের নেতা, হে নেতার পুত্র, তখন রসূল সা বললেন, তোমরা তোমাদের কথা বলো কিন্তু শয়তান যেন তোমাদেরকে বশিভূত করতে না পারে। আমি মুহাম্মাদ, আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, আল্লাহ আমাকে যেই অবস্থানে রেখেছেন আমি পছন্দ করি না যে তোমরা আমাকে তারচেয়ে উপরে উঠাও। (নাসাই শরিফ)

আমরা অন্যকে সম্মান করবো, ইজ্জত করবো তা ঠিক তবে সম্মান করতে করতে সীমা ছাড়িয়ে যাবো— এ অধিকার আমাদের কে দিয়েছে? তাই যারা বাড়াবাড়ি করছেন, ভূয়সী প্রসংসায় মেতে উঠেছেন- তারা হাদীস শরীফের এমন কঠোর নিষেধাজ্ঞা শোনার পরে আশা করি তারা একটু সতর্ক হবেন। আল্লাহই উত্তম সাহায্যকারী।

লেখক : আলেম গবেষক

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *