স্মৃতিতে ভাস্বর কুতবে বাঙাল কাজি মুতাসিম বিল্লাহ রহ.
ফয়জুল্লাহ আমান ❑ এই সময়টা কত পরিবর্তিত হয়ে গেছে ভেবে অবাক হই। কতটা গতি মানুষের জীবনে এসেছে। কত দ্রুতই আমরা পৃথিবীর সব খবরা খবর পেয়ে যাই। সারা বিশ্ব এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। প্রতি দিন নতুন নতুন ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাদের। কয়েক দিনেই পুরনো হয়ে যায় যে কোনো বিষয়। দু দিন আগের কোনো কথা দু দিন পর আর প্রাসংগিক থাকে না। কিন্তু কিছু জিনিস থাকে যা কখনওই হয়ত পুরনো হয় না। আমার জন্য আমার উস্তাদ মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. তেমনই এক ব্যক্তি। সত্যি এই জীবনে তার মত আর কাউকেই পাইনি। কাজি সাহেবের প্রতি মুগ্ধতা আজও কাটেনি। একজন মনীষী কোন উচ্চতা স্পর্শ করলে এমন হয় জানি না।
ঢাকা শহরের অন্য আলেমদের সোহবতেও যাবার সুযোগ আমাদের হয়েছে। কিন্তু কাজি সাহেবের যে রঙ এবং যে মনন তা অন্য কোথাও ছিল না। তার সবচেয়ে বড় অবদান হয়ত এই যে তিনি আমাদেরকে আকাবিরে দারুল উলুম দেওবন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এ দেশে দেওবন্দ ও দেওবন্দি ধারার চর্চার পথিকৃত ছিলেন তিনি। ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হবার পর এখানে দেওবন্দি চিন্তা চেতনা ধরে রাখার মত একজনও ছিল না। হ্যাঁ বাস্তবেই এক কঠিন সময় পার করেছে বাংলাদেশ। ৪৭ থেকে একাত্তরের সময়টা নষ্ট একটা সময় ছিল বাঙালি আলেমদের জন্য। এসময় এখানে সুস্থ চিন্তা লালন করা কতটা কষ্টকর ছিল তা ভাবাই যায় না।
ভারতে মুসলমান খতরায় থাকবে আর পাকিস্তানে ইসলাম খতরায়।
কাজি সাহেব রহ. শাইখুল ইসলাম মাওলানা মাদানী রহ.-এর এ কথা প্রায় বলতেন, ভারতে মুসলমান খতরায় থাকবে আর পাকিস্তানে ইসলাম খতরায়। বর্তমান সময়ে এ বিষয়টি আমরা উপলব্ধি করতে পারি। ভারতের মুসলমানরা অনেক কষ্টের ভেতর থাকলেও সেখানে উগ্রতা বা জঙ্গি চিন্তার কোনো প্রশ্রয় নেই। ইসলামের নামে রাজনীতি করার কোনো নষ্ট চিন্তা নেই। আর পাকিস্তানের অবস্থা সবার জানা। এখনও সেখানে নিত্য দিনে নতুন নতুন ফেতনা মুকাবেলা করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের। বাংলাদেশেও সেই একই অবস্থা ছিল। একাত্তরের বদৌলতে এখন বাংলাদেশের ধর্মীয় পরিবেশ সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর পেছনে আমার প্রিয় উস্তাদের ভূমিকা অনস্বিকার্য। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে তুমি একলা চলো রে।
রবী ঠাকুরের এ কবিতা কাজি সাহেব বুখারীর দরসে প্রায় আবৃত্তি করতেন। সারাটা জীবন তিনি মানুষকে হোদায়াতের নির্মল পথে টানার এবং ইসলামের সুন্দর রূপটি দেখানোর চেষ্টা করেছেন। উন্নত আখলাকের মাধ্যমে তিনি সবাইকে বুঝিয়েছেন ইমান ইসলাম ও ইহসান কী? উপমহাদেশে দারুল উলুম দেওবন্দ যে কত বড় রহমত তা আমরা বুঝতাম না। আমাদের বোঝার মত পরিবেশ ছিল না। কাসেম নানুতুবি রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহি শাইখুল হিন্দ ও শাইখুল ইসলাম মাদানি রহ.-এর চিন্তা চেতনা অনেক উন্নত ও সূক্ষ্ম। স্থূল মস্তিষ্কে এসব ঢুকতে পারে না। বিশেষ করে আমাদের দেশে দীর্ঘ সময় ইসলামের যে চর্চা হয়েছে তাতে ভেজালটাকেই আসল মনে হতো। কাউকে বোঝানো যে কত কঠিন তা দাওয়াতের ময়দায়েনর লোকদের জানা। ইসলাম বলতেই উগ্রতা, জিহাদের নামে সন্ত্রাস, কূপমণ্ডুকতা, দীনদারি মানেই সংকীর্ণতা আর অসচ্ছতা। এই ধরে নিয়েছিল বাঙালি মুসলমান। আলেম সমাজ ইসলামের তাফসীর করত অপরিচ্ছন্ন নোংরা কাপড় পরে। অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলে আর উর্দু ভাষার কিছু চর্চা করে। কঠোরতা ও দুর্ব্যবহারকেই কওমি মাদ্রাসার মূলধন মনে করা হতো। এই পুরো ধারণা বদলে দিয়েছিলেন মাওলানা কাজি মুতাসিম বিল্লাহ রহ.।
কথায় কথায় ধমক আর চিৎকার চেচামেচির বদলে কথায় কথায় উচ্চাঙ্গের কবিতা ও রসাত্মক ভাষায় ইসলামের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা ছিল তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। কাউকে ছোট না করে সবাইকে সম্মান দেওয়ার অনন্য এক গুণ শিখিয়েছেন আমাদের তিনি। নিজেকে ছোট মনে করা যাকে বলে তাওয়াজু আর বিনয় তা যে কত সুন্দর একটি বিষয় তা কেবল বই পুস্তকে পড়ে বোঝা যায় না। বাস্তব জীবনের সংস্পর্শে না আসলে এসব ইসলামিক গুণাবলি হাসিল করা সহজ নয়।
আমরা বাঙালি আলেমরা জানি না সারা বিশ্বে কখনও প্রভাব বিস্তার করতে পারব কি না। যদি কখনও বিশ্বব্যাপী আমাদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে তাহলে এক্ষেত্রে অবশ্যই মাওলানা কাজি মুতাসিম বিল্লাহ রহ.-এর নিভৃত সেই সাধনার অবদান থাকবে। জ্ঞানচর্চার যে ধারা তিনি সৃষ্টি করেছেন তার প্রভাব পুরো দেশেই রয়েছে। এটাকে আমাদের এখন গতিশীল করে ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বময়। তিনি ছিলেন বাংলার কুতুব। কুতবে বাঙাল নামেই আমরা তাকে স্মরণ করি। এমন প্রচার বিমুখ হয়েও তিনি সাধারণ মানুষের মনে আসন করে নিয়েছিলেন। আজও আমরা যে কোনো স্থানে কাজি সাহেব রহ.-এর ছাত্র বলে গর্ব বোধ করি। এই কুতবে বাঙালের আদর্শ সমাজের সবখানে ছড়িয়ে দিতে হবে আমাদের।
বিশ্ব বিশ্ব করে আমরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। সব কিছুতে বহির্বিশ্বের দিকে চোখ। কখনও নিজেদের ভালোটাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার মত সাহস আমাদের হয়ে ওঠে না। চরম হীনম্মন্যতা থেকে এখনও বাঙালি আলেমরা বের হতে পারেনি। আমরা নিজেরা গভীর অধ্যাবসায়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি না এখনও। তাফসীর, হাদীস ও ফিকহের ক্ষেত্রে আজও আমাদের স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মাওলানা কাজি মুতাসিম বিল্লাহ রহ. সেই স্বাতন্ত্র সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। ইজতিহাদি একটা যোগ্যতা যেন অর্জন হয় প্রত্যেকটা আলেমের। এই ইজতিহাদি যোগ্যতার অর্থ বেআদবির মানসিকতা নয় বরং আকাবির আসলাফের জীবনাদর্শ সামনে রেখে সময়ের সমস্যাগুলি সমাধানের যোগ্যতা সৃষ্টি।
হুজুরের স্মৃতি বলতে এখন মালিবাগ জামিআ আর জামিআ ইকরা রয়ে গেছে।
আমার সৌভাগ্য আমি হুজুরের দীর্ঘ দিনের সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম। এমন একজন মুরুব্বির স্নেহধন্য হতে পারা অনেক বড় নিয়ামত। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত হুজুরের নেক তাওয়াজ্জুহ ছিল আমার প্রতি। একেকটা মুহূর্তের কথা মনে পড়ে। ইকরার বুখারীর দরসে বসতাম, আবার মালিবাগ মাদরাসায় গিয়েও দরসে শরিক হতাম, অসুস্থ হলে হস্পিটালে গিয়ে হুজুরের সেবার সুযোগও হতো এছাড়া হুজুরের বাসায় যশোর বাড়িতে এবং একসাথে সফরেও থেকেছি বেশ কবার। হুজুরের ইন্তিকালের পর আম্মা হুজুরের কাছে যেতাম আমার বাচ্চাদের নিয়ে। ২০১৮ সালে আম্মা হুজুরও ওপারে চলে গেলেন। হুজুরের স্মৃতি বলতে এখন মালিবাগ জামিআ আর জামিআ ইকরা রয়ে গেছে।
জামিআ ইকরার পথচলা শুরু হয়েছিল কাজি সাহেবকে দিয়েই। আমাদের শাইখুল জামিআ মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ দা. বা. এখনও প্রায় বলেন, মাওলানা কাজি মুতাসিম বিল্লাহ রহ.-এর আগ্রহেই ইকরার প্রতিষ্ঠা। এই দুই শায়খ বড় স্বপ্ন নিয়ে জামিআ ইকরায় হাদীসের দরস শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশে যেন সুস্থ ধারায় ইলম চর্চা হতে পারে। আকাবিরে দেওবন্দের চিন্তা চেতনার লালন যেন হতে পারে। জানি না তাদের সে স্বপ্ন কতটুকু পুরণ করতে পারব আমরা। আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে, পূর্ণ করবেন আল্লাহ তায়ালা। আল্লাহর জন্য যে কাজ করা হয় তা কখনওই বৃথা যায় না। বৃথা যেতে পারে না।
আজ থেকে সাত বছর আগে ২০১৩ সালের রমজানে কাজি সাহেব ইন্তিকাল করেছেন। দেখতে দেখতে সাতটি বছর পার হয়ে গেল। প্রত্যেক রমজানেই আমাদের মনে পড়ে যায় ইন্তিকালের সময়ের কথা। ইফতারের আগ মুহূর্তে চুপচাপ কিভাবে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। মনে হয় যতটা তার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা হওয়ার দরকার তা করা যায়নি। কাজী সাহেব রহ.-এর চিন্তা চেতনা ও জীবনের ঘটনাবলির চর্চা আরও সমৃদ্ধ করতে হবে আমাদের। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কবরকে নুর দিয়ে ভরপুর করে দিন। জান্নাতুল ফিরদাউসের আলি মাকাম নসিব করুন। কেয়ামত তক তাঁর ফুয়ূজ ও বারাকাত জারি ও সারি রাখুন এবং তার আদর্শকে আমাদের জীবনে ধারণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও সমাজ বিশ্লেষক